বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রংপুর নগরীর রাধাকৃষ্ণপুর মৌলভীপাড়ায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় জামায়াত কর্মী ছমেস উদ্দিনের মৃত্যুর প্রায় ১০ মাস পর একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। মামলায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম থাকলেও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের নাম নেই। মামলার বাদী হিসেবে নাম থাকলেও নিহতের স্ত্রী আমেনা বেগম দাবি করেছেন, মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি অবগত নন। পুলিশের ধাওয়ায় তার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে তিনি জানান।
ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ২ আগস্ট। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছমেস উদ্দিনকে আটক করতে হাজির হন পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ওই সময় ছমেস উদ্দিন নিজ বাড়ির লাগোয়া মুদি দোকানে অবস্থান করছিলেন। তাকে বাইরে বের হতে বললে তিনি পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাকে ধাওয়া করে। দৌড়াতে গিয়ে ছমেস উদ্দিন পড়ে গেলে তাকে মারধর করা হয়। পরে পুলিশ তাকে জামার কলার ধরে গাড়িতে তুলতে গেলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার দীর্ঘ সময় পর, চলতি বছরের জুন মাসে আমেনা বেগম বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ মোট ৫৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) একজন শিক্ষকও রয়েছেন আসামিদের তালিকায়।
তবে মামলার এজাহারে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নিহত ছমেস উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম জানান, মামলার আসামি কারা হয়েছেন, তিনি তা জানেন না। শুধু একটি কাগজে স্বাক্ষর করেছেন। তার ভাষ্য মামলাটি জামায়াত ও পুলিশের পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী ও মৃতের পরিবারের সদস্যরা জানান, ঘটনার সময় হাজিরহাট থানার অন্তত ৫-৬ জন পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন এবং তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন; কিন্তু মামলার এজাহারে কোনো পুলিশ সদস্যের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মৃত ছমেস উদ্দিনের ছেলে আশিকুর রহমান জানান, শুরুতে ঝামেলা এড়াতেই তারা মামলা করেননি। তবে মে মাসের মাঝামাঝি সময় মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের ডেকে নেওয়া হয়। তখন পুলিশ জানায়, তার বাবার মৃত্যুর ঘটনায় ওপর মহল থেকে মামলা করার নির্দেশ এসেছে। পরিবার যদি মামলা না করে তাহলে পুলিশ নিজেরাই বাদী হয়ে মামলা করবে। পরে তারা সময় নিয়ে বাড়ি ফেরেন। কিছুদিন পর আবার হাজিরহাট থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে মামলা করতে বলা হয়। এরপর তারা মহানগর জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আশিকুর রহমান বলেন, ‘এ মামলায় কাকে আসামি করা হয়েছে, আমরা জানি না। মামলার বাদী আমার মা শুধু কাগজে সই করেছেন।’
এদিকে নিহত ছমেস উদ্দিনকে রংপুর নগরীর রাধাকৃষ্ণপুর বাগানবাড়ি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কবরের চারপাশে বাঁশের বেড়ায় একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে, ‘জাতীয় বীর ছমেছ উদ্দিন গত ২ আগস্ট ২০২৪ পুলিশ বিভাগের একটি দল তার বাড়িতে প্রবেশ করলে তিনি পুলিশ দেখে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে যান এবং তিনি সেখানেই স্ট্রোক করে মারা যান, তা নিশ্চিত করে প্রাইম মেডিকেল কলেজের ডাক্তার।’
মামলার বাদী ও প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ: এই ঘটনা নিয়ে মামলার বাদী আমেনা বেগমের সঙ্গে তার বাড়িতে কথা হয় কালবেলার প্রতিনিধির। তিনি জানান, ঘটনার দিন বিকেলে তিনটি মোটরসাইকেলে করে ছয় পুলিশ সদস্য দোকানে আসে। পুলিশ দেখে ছমেস উদ্দিন দোকান থেকে বের হয়ে পালাতে চেষ্টা করলে তাকে ধাওয়া করা হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি পড়ে যান। পরে পথচারীরা তাকে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখে খবর দিলে স্থানীয় বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন সেখানে যান। মোশাররফ তাকে প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান, তিনি আগেই মারা গেছেন।
মামলায় কারা আসামি হয়েছেন, জানতে চাইলে আমেনা বেগম বলেন, ‘আমি বাদী হয়েছি ঠিকই, কিন্তু সংগঠন (জামায়াত) আমাকে কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে, আপনি সাইন দেন। আমি কি জানি কে কোনটা, কার বয়স কত, কে কী করেছে, আমি তো কিছুই জানি না।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার সাক্ষী স্থানীয় বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন জানান, ঘটনার দিন বিকেলে তিনি ছমেস উদ্দিনের দোকানে যান। এক পর্যায়ে তিনটি মোটরসাইকেলে পুলিশসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে আসে। তখন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতারা ছমেস উদ্দিনকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। এ সময় তার স্ত্রী এসে প্রতিবাদ করেন। তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে ছমেস উদ্দিন দোকান থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা তাকে ধাওয়া করে। কিছুদূর গিয়ে তাকে ধরে ফেলা হয় এবং ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। পরে পুলিশ তার জামার কলার ধরে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তখন পুলিশ তাকে ফেলে চলে যায়। এরপর আওয়ামী লীগ নেতারাও সরে পড়ে।
মামলার এজাহারের সঙ্গে বাদী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যের মিল নেই: এ ঘটনায় গত ৩ জুন রংপুর নগরীর হাজিরহাট থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের ২ আগস্ট সন্ধ্যায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসক এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রাধাকৃষ্ণপুরে তার বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। ওই সময় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি অহেদুল ইসলাম তার স্বামী ছমেস উদ্দিনকে দোকান থেকে বের হতে বললে তিনি পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় আসামিরা আসামিরা তাকে ঘিরে ফেলে দেশি অস্ত্র দিয়ে মাথা, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছমেস উদ্দিনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন। রামদা ও লোহার রড দ্বারা এবং পিঠের পেছনে চাইনিজ কুড়াল ও চাপাতি দ্বারা এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করা হয়।
তবে এজাহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের বড় ধরনের অমিল রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, ছমেস উদ্দিনকে ধাওয়া ও মারধরে পুলিশও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল এবং পুলিশ সদস্যরা তাকে জামার কলার ধরে গাড়িতে তোলার সময় তিনি জ্ঞান হারান। অথচ এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এজাহারে নেই। বরং সেখানে বলা হয়েছে, আসামিরা ছমেস উদ্দিনকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। অন্যদিকে, মামলার ৫৪ নম্বর আসামি হিসেবে বেরোবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হকের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না।
এ ছাড়া মামলার সাক্ষী ও লাশের গোসলদানকারী মোশারফ হোসেন বলেন, ‘রামদা, চাইনিজ কুড়াল ও চাপাতি দ্বারা আঘাত করা হয়নি।’
স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে আমেনা বেগম অভিযোগ তুলছেন, তাদের নাম এজাহারে নেই—এ কথা জানানো হলে তিনি বলেন, ‘তারা তো উপস্থিত ছিল। তারা পেছনে দৌড়িয়েছে। যারা জড়িত আমি তাদের বিচার চাই। মামলায় কার নাম আছে আমি জানি না।’
জামায়াত যা বলছে: মামলায় জামায়াতের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হয়নি বলে দাবি করেছেন মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি আনোয়ারুল হক কাজল। তিনি বলেন, ‘মামলাটি করেছে নিহতের পরিবার। এটি তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দলীয় বা সাংগঠনিকভাবে কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। তবে কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করে থাকেন, সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার।’
পুলিশের বক্তব্য: মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মজিদ আলী কালবেলাকে বলেন, মামলার এজাহারে বাদী আমেনা বেগমের স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি যদি কোনো মিথ্যা বা বানানো তথ্য দিয়ে থাকেন, তাহলে তার জবাবদিহিও আদালতেই করতে হবে।
বেরোবি শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কমিশনার বলেন, তিনি তাজহাট থানার আরেকটি মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি তদন্তে কারও সংশ্লিষ্টতা পান, তাহলে আদালতের নির্দেশেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তদন্ত কর্মকর্তার দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহি আদালতের কাছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল আল মামুন শাহ বলেন, ‘এখনই বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না। বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।’
মামলায় বেরোবি শিক্ষক গ্রেপ্তারে প্রতিবাদ: বৃহস্পতিবার বিকেলে ছমেস উদ্দিন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি বেরোবি শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার দুপুরে তারা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করেন। সেখানে বক্তারা বলেন, মাহমুদুল হককে একটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, যার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারা অবিলম্বে তার মুক্তি ও মামলার দায় থেকে অব্যাহতির দাবি জানান।
মন্তব্য করুন