ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্রেডিট রেটিং ব্যুরো তৈরির নীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে গ্রাহক নির্বাচনে সহায়তা পাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গ্রাহকের আর্থিক ও ব্যবসায়িক সক্ষমতা যাচাই করা হচ্ছে। তবে তৃতীয় পক্ষের রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করা কতটা নিরাপদ হবে—বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের ব্যাংক খাতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ জন্য ঋণ গ্রহীতাদের যোগ্যতা যাচাইয়ে ব্যাংকের দুর্বলতাকেই দায়ী করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা যাচাইয়ে প্রাইভেট ক্রেডিট ব্যুরো (পিসিবি) নামে নতুন সংস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী এই সংস্থা গ্রাহকের সম্পদ ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে রেটিং দেবে। ওই রেটিংয়ের ভিত্তিতেই গ্রাহক ঋণ পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ব্যক্তি পর্যায়েও ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং কোম্পানির মাধ্যমে প্রাপ্ত রেটিংকে আমলে নেবে ব্যাংক। এ-সংক্রান্ত নীতি তৈরির জন্য শিগগির কাজ শুরু করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কার্যক্রমের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মডেল অনুসরণ করে নীতি তৈরি করা হবে। এর ভিত্তিতে ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের জন্য আইডিয়া ও প্রস্তাবনা আহ্বান করা হবে। পর্যালোচনা শেষে এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে। তথ্যমতে, বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট রেটিং নিতে পারবে যেকোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে ব্যক্তির আয়, সম্পদ, কর প্রদানের তথ্য এবং লেনদেনসহ বিভিন্ন আর্থিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিয়ে একাধিক রেটিং অনুমোদন করবে ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে গ্রাহক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজস্ব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যাচাইয়ের ওপর ভিত্তি করে ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংকের বোর্ড বা অনুমোদিত বিভাগ। ক্রেডিট রেটিং পদ্ধতি চালু হলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনার বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিতে পারবে ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পদ্ধতি চালু হলে ঝুঁকিমুক্ত ঋণ বিতরণ অনেকটা সহজ হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক-গ্রাহক যোগসাজশে বেনামি ও কাগুজে কোম্পানিকে নামে ঋণ নেওয়া বন্ধ হবে। ব্যাংকাররা বলছেন, তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভর করলে ঋণ বিতরণে ঝুঁকি থাকবে। কারণ বর্তমানে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভালো রেটিং সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং কোম্পানির গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতের পাশাপাশি ব্যাংকের নিজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন কালবেলাকে বলেন, ক্রেডিট কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে কিছু কোম্পানি এ ধরনের কাজ করে। আর কিছু কিছু ব্যাংক প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে ঋণ বিতরণের আগে গ্রাহকের জামানতসহ বিভিন্ন বিষয় দেখভালের দায়িত্ব দেয়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের কোম্পানি অনুমোদন দিলে সেক্ষেত্রে ঋণ খারাপের দায় তাদের ওপরও বর্তাবে, এটা ভালো। এখন অডিট কোম্পানিগুলোকে দায় নিতে হয়।
গত বছরের অক্টোবরে নগদ ও কড়িকে ডিজিটাল ব্যাংকের উইন্ডো খুলে প্রাথমিক কাজ সম্পাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। নগদ প্রাথমিক কাজ সম্পাদন করায় তাদের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করতে আর কোনো বাধা থাকল না নগদের। অন্যদিকে প্রাথমিক কাজ শেষ করতে সক্ষম না হওয়ায় কড়িকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর এ মিশুক কালবেলাকে বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকের কার্যক্রম শুরুর জন্য নগদের আরও একটি ধাপ বাকি। বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেই দেশের প্রথম ডিজিটাল ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করবে নগদ।
রেটিং কোম্পানিগুলো যেভাবে কাজ করে: আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেটিং কোম্পানি আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্য, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, ঝুঁকি প্রোফাইলসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে। বিশেষজ্ঞরা সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা মূল্যায়ন করে রেটিং নির্ধারণ করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানটির রেটিং প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দেশে বর্তমানে সর্বোচ্চ ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকলে AAA/Aaa, খুব উচ্চ ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকলে AA/Aa, উচ্চ ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকলে A/Ba, মধ্যম-উচ্চ ঋণ পরিশোধের ক্ষমতার ক্ষেত্রে BBB/Baa, মধ্যম ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা BB/Ba, মধ্যম-নিম্ন ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা B/Ca, নিম্ন ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা CCC/Cc এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় D রেটিং।
রেটিংয়ের ব্যবহার: এটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। এ ছাড়া ঋণের সুদহার নির্ধারণে ব্যবহার হয়। এটি প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি মূল্যায়নেও সহায়তা করে। দেশে বর্তমানে রেটিং নিয়ে কাজ করে আলফা ক্রেডিট রেটিং, আর্গুস ক্রেডিট রেটিং সার্ভিসেস, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ, ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস, ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং, ন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিংস ও দ্য বাংলাদেশ রেটিং এজেন্সি।