চোখে কালো কাপড় বাঁধা। স্কুলের পোশাকে হাতজোড় করে আছে কোমলমতি ছোট্ট শিশুরা। কারও হাতে পোস্টার। অনেকেই বসে আছেন রাস্তায়। কেউবা মাটিতে শুয়ে আছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবার একটাই আকুতি,Ñতাদের শেষ আশ্রয়টুকু যেন ভেঙে ফেলা না হয়। বলা হচ্ছে রাজধানীর বংশালে হরিজন সম্প্রদায়ের মিরনজিল্লা পল্লির কথা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পল্লিটিতে বুলডোজারসহ উচ্ছেদের সরঞ্জামাদি রেখেছে। মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ। সেখানে উপস্থিত সিটি করপোরেশনের বড় বড় কর্মকর্তাসহ শ্রমিক। ৪০০ বছরের পুরোনো এই পল্লি উচ্ছেদ করে এখানে নতুন করে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেখানে নির্মাণ হবে কাঁচাবাজার। এতে বেশ সহযোগিতা করছেন স্থানীয় ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। মেয়রের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়ার পরও গত সোমবার দুপুর থেকে মিরনজিল্লা পল্লি উচ্ছেদে নামে সিটি করপোরেশন।
এদিকে উচ্ছেদের ঘটনায় গত সোমবার লক্ষ্মী রানী নামে এক নারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি উচ্ছেদে ভীত হয়ে মারা যান বলে অভিযোগ হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের। এ ছাড়া গতকাল বিকেলে শাম্মী দাস নামে এক কিশোর উচ্ছেদ হওয়া জমিতে থাকা একটি গাছে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সে ঢামেকের ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। স্থানীয়রা জানায়, আত্মহত্যার চেষ্টাকারী শাম্মী দাসের চোখের সামনে তার ঘরবাড়ি সবই গেছে। সে এখন কোথায় থাকবেÑএই ভাবনা থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে পাঁচ শতাধিক পরিবারের চার হাজারের বেশি মানুষের বসতি, যাদের মধ্যে ৬৬ জন বর্তমানে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত। বাকি সবাই অবৈধ। বৈধ ৬৬ জনের হাতে এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে ফ্ল্যাটের চাবি। যদিও তারা বলছেন, সবাইকে চাবি দিলেই তবেই তারা নতুন ঘরে উঠবেন।
পল্লির বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভবন নির্মাণের জন্য ২০টি ঘরের কথা বলে সোমবার ৮০টি বসতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের আগেই আবারো বস্তি উচ্ছেদে আসে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এসব দেখে বসতির কোমলমতি শিশুদের কেউ স্কুলে যায়নি। তারা প্রত্যেকেই স্কুলের পোশাকে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। হাত জোড় করে তারা মিনতি করছে, ‘আমাদের পুনর্বাসনের আগে উচ্ছেদ করো না। দোহাই লাগে। আমরাও মানুষ। বাঁচতে চাই। বাঁচতে দাও। আমাদের এভাবে রাস্তায় ফেলে দিও না।’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ কালবেলাকে বলেন, অসহায় মানুষদের এভাবে উচ্ছেদ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধের দাবি জানান তিনি।
বাসিন্দারা বলছেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, দেশে কেউ ঘরহীন থাকবেন না। এর পরও ডিএসসিসি পুরান ঢাকার বংশালের আগা সাদেক রোডের মিরনজিল্লার সুইপার কলোনি কেন উচ্ছেদ করা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত কালবেলাকে বলেন, সরকারি দল এবার যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে, সেখানে যেসব অঙ্গীকার, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, অনগ্রসর হরিজন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও তাদের বাসস্থানের মতো বিষয়ের উন্নতিতে সরকার অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করবে। এটা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মনে করিয়ে দিয়েছি। বলেছি, পুনর্বাসন না করে কাউকে উচ্ছেদ করা আইনবিরুদ্ধ।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণলাল কালবেলাকে বলেন, আমরা তো এই দেশের নাগরিক। তাহলে সামান্য বসতির অধিকারটুকু কেন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের জোর করে কেন রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টার পর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে বুলডোজার নিয়ে কলোনির কাছাকাছি একটি স্কুলের পাশে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে পুলিশ প্রত্যাহার করেনি। তেমনি হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনদের রাস্তায় বসে থাকতে দেখা গেছে।
এদিকে মিরনজিল্লা পল্লি উচ্ছেদের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। দলের পক্ষ থেকে এক বার্তায় তাদের উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের দাবি জানানো হয়েছে।