বড় সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনায় এখনো আন্তর্জাতিক আইন ও তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ দিতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে চুক্তির অনিয়ম বা সুপারিশ কার্যক্রম পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি। একই সঙ্গে বিতর্কিত আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনায় ১৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিলেও কোনো অগ্রগতি নেই।
উল্লেখ্য, গত ২৬ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে এ সুপারিশ করে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, জাতীয় পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন ও তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। যত দ্রুত সম্ভব নিয়োগ করা হবে।
জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্বাক্ষর হওয়া বড় সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে চুক্তি পর্যালোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় কমিটি প্রাথমিকভাবে বেশকিছু অনিয়ম পায়। পর্যালোচনা কমিটি এমন কিছু তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছে, যা আন্তর্জাতিক সালিশি আইন ও কার্যধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চুক্তি পুনর্বিবেচনা বা বাতিল করতে হতে পারে।
চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির দুজন সদস্য বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে যেসব অনিয়ম চিহ্নিত করেছি, তা নিয়ে এগোতে চাইলে আইনগতভাবে করতে হবে। এজন্য দেশি বা আন্তর্জাতিক আদালতে আরবিট্রেশন বা মামলায় যেতে হবে। এগুলো যেন ভ্যালিড হয়; তাই আন্তর্জাতিক আইন ও তদন্তকারী সংস্থাকে অবিলম্বে যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে এ ধরনের মামলা ও সহায়তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি শুরুতে সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির বিষয়ে কাজ শুরু করে। এগুলো হলো ভারতের গড্ডায় নির্মিত আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সামিটের নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াট ডুয়াল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ৫৮৩ মেগাওয়াট ডুয়াল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইউনাইটেড ও আশুগঞ্জ পাওয়ারের যৌথ উদ্যোগের ১৯৫ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মিত এস আলমের ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ইউনিক গ্রুপের মেঘনাঘাট ৫৮৪ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) বিদ্যুৎকেন্দ্র।
জানা গেছে, এই সাত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনায় গুরুত্ব দেওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, একই ধরনের অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও নির্মাণব্যয় নির্ধারণ কীভাবে করা হয়েছে প্রাথমিকভাবে তা যাচাই করা হয়েছে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয় সরকারের তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। আবার নির্মাণব্যয় বেশি দেখিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জও অধিক নির্ধারণ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিশেষ আইনে বিনা দরপত্রে লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের অনৈতিক লেনদেন করা হয়েছে, তা বের করার চেষ্টা করছে কমিটি। সুবিধাভোগীদেরও চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রসহ বেসরকারি খাতে আওয়ামী লীগের সময়ে ৯১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর বেশিরভাগই দরপত্র ছাড়া। ফলে এগুলোর নির্মাণব্যয় বেশি। এতে ক্যাপাসিটি চার্জের হারও ছিল দুই থেকে তিনগুণ।
এদিকে আদানির চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করার দাবিতে গত নভেম্বরে একাধিক রিট মামলা করা হয়। ফলে ১৯ নভেম্বর আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেডের সঙ্গে সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিবকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কমিটি গঠনের পর দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্টে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই সময়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নথি দাখিল করতেও বলা হয়। একই সঙ্গে হাইকোর্ট আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা চুক্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে রুল জারি করেছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দেওয়ার জন্য আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে।