কখনো পরিচয় দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘কনসালট্যান্ট’, কখনো আবার পরিচয় দেন এনএসআইর কর্মকর্তা। আবার পরিচয় দেন ডিজিএফআই অথবা ডিবির কর্মকর্তা হিসেবে। আসলে তিনি শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত একজন সামরিক কর্মকর্তা। নাম শেখ আবু মাহদী। ছিলেন মেজর পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া, দুদকের ‘কনসালট্যান্ট’ পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজির ও কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তাকে হুমকি ও নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাহদীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে মামলা করেছেন শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। মামলায় তিনি মাহদীর বিরুদ্ধে ২ কোটি টাকা চাঁদাবাজি, হয়রানি ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ এনেছেন। এজাহারে শাহরিয়ার আহমেদ উল্লেখ করেন, ‘গত বছরের ১৪ আগস্ট জনৈক গিয়াস উদ্দিন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য তার কাছে তথ্য চান। গিয়াস বাদীকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মেট্রো লাউঞ্জ রেস্টুরেন্টে ডাকেন। সেখানে যাওয়ার পর গিয়াসের সঙ্গে অজ্ঞাত তিনজন ব্যক্তি আসেন, যারা নিজেদের এনএসআই সদস্য পরিচয় দেন। এনএসআই সদস্য পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা বাদীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে যৌথ বাহিনী কর্তৃক গুম করার হুমকি দেন। বাদীকে বাঁচতে হলে মামলার ২ নম্বর আসামি আবু মাহদীকে ২ কোটি টাকা দিতে হবে বলে জানান। অন্যথায় দুদুকসহ বিভিন্ন স্থানে মামলা দেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানি করাসহ গুম ও অপহরণ করাসহ বিভিন্ন হুমকি দেন। বাদী ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ‘২ কোটি টাকা দেবেন’ বলে প্রাণে বেঁচে ফিরেন। পরদিন আসামি গিয়াস ধানমন্ডির জেমকন টাওয়ারে অবস্থিত একটি কপি শপে যেতে বলেন। সেখানে আসামিদের পক্ষে ২০ লাখ টাকা নগদে নেন। বাকি টাকা আস্তে আস্তে দেবেন বলে জানান। ওই ঘটনার দুদিন পর বাদী শাহরিয়ারের কাছ থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক দাবি করেন। ওইদিন সন্ধ্যায় নানান ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে জনতা ব্যাংক ফার্মগেট করপোরেট শাখার চারটি চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লিখে নেন। গিয়াস, মাহদী ও আমান নামে তিন ব্যক্তি চেক নেওয়ার পর সেটা নগদায়ন করার জন্য নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। বাদী পরবর্তী সময়ে আদালতে মামলা করেন।’ এ ছাড়াও শাহরিয়ার চৌধুরীর কাছ থেকে জোরপূর্বক চেক নেওয়ার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেছেন।
মাহদী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জুলস পাওয়ার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিককে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ৩ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা জানান, জুলস পাওয়ার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় সৌরবিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ করে। গত ৩ মার্চ শেখ আবু মাহদী মোবাইল ফোনে তাদের টেকনাফ অফিসের ল্যান্ড কো-অর্ডিনেটর হেলালকে ফোন করে হুমকি দেন এবং হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দেওয়ার কথা বলেন। এর আগে গত ২২ ডিসেম্বর একই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাহিদুজ্জামানকে ফোন করে তার চাহিদা মাফিক টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে দুদকে মামলা দেওয়া, পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা ও কোম্পানি চেয়ারম্যান মাহবুব আলমকে হত্যার হুমকি দেন।’ জুলস পাওয়ারের কর্মকর্তারা জানান, মাহদী তাদের কাছে ৩ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন।
মাহদী বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইলে খুদেবার্তা দিয়েছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি ১৬ বছর ধরে বিদ্যুৎ খাতের অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করি। আমাকে আমার প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন। মাই কন্টাক্ট: মেজ. মাহদী (অব.)।’ এভাবে বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুদেবার্তা পাঠিয়ে তথ্য চান মাহদী। পরে ওইসব ব্যক্তির কাছে চাঁদা চাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, “মেজর মাহদী পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎ ভবনে যান। তিনি নিজেকে দুদকের ‘কনসালট্যান্ট’ পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও অর্থ দাবি করেন।” এ ছাড়া দুদকের জ্যাকেট পরা কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি কয়েক দফায় অভিযানে আসেন। ওই ব্যক্তিরা প্রকৃত পক্ষেই দুদকের লোক কি না, সেটা নিশ্চিত হতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শেখ আবু মাহদী সম্পর্কে জানা গেছে, ‘তিনি একসময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তিনি ৩৭তম লং কোর্সে কমিশন পান। মেজর পদে থাকা অবস্থায় জমি দখলসহ নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
দুদকের একজন পরিচালক জানান, ‘দুদকে কনসালট্যান্ট নামে কোনো পদ নেই। দুদক এভাবে কাউকে নিয়োগ দেয় না। যদি কেউ দুদকে নিয়োগ পান, তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তার নিয়োগপত্র দিতে হবে; কিন্তু দুদক বা জনপ্রশানস মন্ত্রণালয় এ ধরনের পদে কাউকে নিয়োগ দেয়নি।’ কমিশনের একজন মহাপরিচালক জানান, “অবসরপ্রাপ্ত মেজর মাহদী কমিশনের কথিত ‘কনসালট্যান্ট’ পরিচয় দেওয়া ও বিভিন্ন জনের কাছে তথ্য চাওয়ার বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি। কিন্তু কমিশন এ ধরনের পদে কাউকে নিয়োগ দেয়নি। মাহদীর বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।” দুদকের অন্য এক কর্মকর্তা জানান, ‘দুদকের একজন কমিশনার মৌখিকভাবে বিদ্যুৎ বিভাগে অনিয়ম-সংক্রান্ত কমিটিকে মাহদীর কাছ থেকে কোনো প্রয়োজন হলে সহযোগিতা নিতে বলেন। এর পর থেকেই মাহদী নিজেকে কনসালট্যান্ট পরিচয় দিতে শুরু করেন।’ মাহদীর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ওই কমিশনার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অভিযোগের বিষয়ে শেখ আবু মাহদী কালবেলাকে বলেন, ‘আমি মাস দুয়েক ধরে দুদকের সঙ্গে কাজ করি। দুদকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি অভিযানে গিয়েছি। তাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছি।’ আপনি দুদকের ‘কনসালট্যান্ট’ পরিচয় দেন কেন, আপনাকে কি দুদক কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদককে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করেন। তারাই তাদেরটা বলুক।’
শাহরিয়ার আহমেদের অভিযোগের বিষয়ে আবু মাহদী বলেন, ‘আমাকে তিনি হয়রানি করেছেন এবং ১ কোটি টাকার চেক সই করে নিয়েছেন। এখন তিনি নিজের অপকর্ম ঢাকতে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।’
মন্তব্য করুন