কবির হোসেন
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ০৮:৫৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অধস্তন আদালতে সহায়ক কর্মকর্তা কর্মচারীর তিন হাজার পদ শূন্য

আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে জনপ্রশাসনের অনুমোদন
অধস্তন আদালতে সহায়ক কর্মকর্তা কর্মচারীর তিন হাজার পদ শূন্য

সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোর সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন হাজারের বেশি পদ শূন্য রয়েছে। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে এসব শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে অধস্তন আদালতের দুটি নিয়োগ বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। সংশোধিত বিধিমালার খসড়া নিয়োগবিধি পরীক্ষণ-সংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপকমিটির কাছে উত্থাপন হয়। চলতি সপ্তাহে এই উপকমিটি প্রস্তাবিত খসড়া নিয়োগ বিধিমালা পর্যালোচনা করে সেটি প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণের সুপারিশ করেছে। এখন সচিব কমিটিতে অনুমোদনের পরই নতুন নিয়োগ বিধি কার্যকর হবে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোয় সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। তিনি নিম্ন আদালতের অধিকাংশ কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। লোকবল নিয়োগে তিনি একটি নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে সারা দেশের আদালতগুলোয় তিন হাজারের বেশি লোক নিয়োগ হয়েছে শুধু সাবেক মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা থেকে। টাকার বিনিময়ে অদক্ষ-অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়ায় বিচার বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগে নিয়োগ নিয়ে এই তুঘলকি কাণ্ড দেখে হতবাক ও বিস্মিত মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পরে নিয়োগ বিধি সংশোধন করে বিচার বিভাগে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, জেলা জজ ও অধস্তন আদালতগুলো এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতগুলোর সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ১ হাজার ৭৫২টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতগুলোয় সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ১ হাজার ২১৬টি পদ শূন্য রয়েছে। আদালতগুলোয় এসব সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া ও কার্যক্রমকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গতিশীল করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারকদের দিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করায় গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং নিয়োগ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বিচারকদের আদালতে মামলা জট সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া লোকবল নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়মের অপবাদ বিচারকদের ঘাড়েও পড়ছে। বিচারলয়কে পবিত্র ও বিচারকদের স্বচ্ছ রাখতে তাদের হাত থেকে নিয়োগ কার্যক্রম সরাতে জেলা জজ ও অধস্তন আদালতগুলো এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতগুলো (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯ এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতগুলো (সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮-এর সংশোধন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ সংশোধনীর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এ সংশোধিত বিধিমালা কার্যকর হলে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে লোকবল নিয়োগের জন্য একজন অতিরিক্ত ও একজন যুগ্ম জেলা জজ এবং একজন সিনিয়র সহকারী জজের সমন্বয়ে প্রার্থী বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি প্রার্থী বাছাই করে নিয়োগের জন্য জেলা জজের কাছে সুপারিশ করেন। সুপারিশ অনুযায়ী জেলা জজ নিয়োগ দিয়ে থাকেন; কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। ওপরের হস্তক্ষেপে নিয়োগ নিয়ে বিরক্ত অনেক জেলা জজও। বিধি সংশোধনের পর নিয়োগ প্রার্থী বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ হবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন। এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারপতি, জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিব, আইন সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ ১০ সদস্যের এই কমিশন পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী বাছাই করবেন। এরপর প্রার্থী তালিকা তৈরি করে নিয়োগের সুপারিশ করবেন। তালিকা থেকে জেলা জজ নিয়োগ প্রদান করবেন। এতে করে নিয়োগের ক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নিয়োগের ক্ষমতা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের হাতে নেওয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিচারকরাও। বেশ কয়েকজন বিচারক বলেছেন, ‘এটা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বিচারক বিভাগকে পবিত্র রাখার জন্য এটা জরুরি ছিল। টাকার বিনিময়ে অযোগ্য-অদক্ষ লোকবল নিয়োগ করায় বিচারকরাও বিপাকে পড়েন। কারণ, অনেক সহায়ক কর্মচারী ঠিকমতো টাইপ করতে পারেন না, আদালতের কাজে কোনো গতি থাকে না। বিচারপ্রার্থীদেরও হয়রানি বাড়ে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আশা করি কমিশনের মাধ্যমে আদালতে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হবে। দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হলে বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশিত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।’

‘নিয়োগ বিধিমালা সংশোধনের খসড়ায় যা বলা আছে’

বিচার বিভাগের সহায়ক জনবল নিয়োগের জন্য প্রচলিত দুটি নিয়োগ বিধিমালার সংশোধনীতেই বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ (জেলা জজ) বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ (সার্ভিস কমিশন) কর্তৃক বাছাইকৃত উপযুক্ত প্রার্থীদের তালিকা থেকে ওই পদে নিয়োগদান করবে। সরাসরি নিয়োগে বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ কোনো প্রার্থীর লিখিত, ব্যবহারিক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয় বিবেচনা করবে। এতে আরও বলা হয়েছে, বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত উপযুক্ত প্রার্থীদের তালিকা প্রাপ্তির ১৫ (পনেরো) কার্যদিবসের মধ্যে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ শূন্যপদে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।

খসড়াবিধিতে বলা হয়েছে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কোনো নির্দিষ্ট পদ শূন্য হওয়ার এক মাসের মধ্যে সরাসরি নিয়োগের লক্ষ্যে শূন্যপদের তালিকা বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করবে এবং বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ সব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত শূন্যপদগুলোর সংখ্যা একত্রিতভাবে প্রতি বছর এক বা একাধিকবার বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের প্রয়োজনে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণে জুডিশিয়াল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মৌখিক পরীক্ষার বোর্ড বা বোর্ডসমূহ গঠন করতে পারবে এবং ওই বোর্ড বা বোর্ডসমূহে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে কারিগরি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।

বিশেষ বিধান করে এই খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে চলমান কোনো সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন না হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বৈধ প্রার্থীদের আবেদনসমূহ, তদসংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে বাছাইকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করবে। বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বর্ণিত আবেদন, তদসংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রাপ্তির পর তার ভিত্তিতে বাছাই-সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদন আহ্বানের প্রয়োজন হবে না। তবে বিধিমালার এ সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে কোনো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে থাকলে এবং তৎপরবর্তী কোনো ধাপ অনিষ্পন্ন থাকলে ওই পদের নিয়োগ ও বাছাই কার্যক্রম এমনভাবে সম্পন্ন করতে হবে, যেন বিধিমালার এই সংশোধনী জারি হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিরাজকে দ্বিতীয় টেস্টে পাচ্ছে বাংলাদেশ

৮ ছানাসহ মা পাতি সরালি ফিরেছে আপন ঠিকানায়

সন্ধ্যার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড়

ক্লাব বিশ্বকাপে বড় অঘটন, পিএসজিকে হারিয়ে দিল ব্রাজিলের ক্লাব

দাঁত ভালো রাখতে একটি টুথব্রাশ কতদিন ব্যবহার করা উচিত?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : গত ২৪ ঘণ্টায় যা যা ঘটল

পিরোজপুরে ব্রিজ ভেঙে খালে কয়লাবোঝাই ট্রাক, যান চলাচল বন্ধ

ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের বৈঠক কী বার্তা দিচ্ছে

ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হলেও ভয়াবহ বিপদে পড়তে পারেন খামেনি

জেনেভা বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন কারা, উদ্দেশ্য কী

১০

নিজ বাড়িতে মিলল ইসরায়েলি ২ নারীর গুলিবিদ্ধ মরদেহ

১১

বারবার ন্যাড়া হলে কি সত্যিই চুল ঘন হয়?

১২

২ কোটির বরাদ্দ রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে কাদায়!

১৩

ইরান পারমাণবিক বোমা বানাতে পারে দুই কারণে

১৪

খামেনিকে হত্যার শঙ্কা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পুতিন

১৫

সকালের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড়

১৬

ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে ‘শাস্তি হতে পারে’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর

১৭

জামিন নিতে গিয়ে কারাগারে সাবেক এমপি নূর মোহাম্মদ

১৮

চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে ইংরেজিতে দক্ষ হবেন যেভাবে 

১৯

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের কাছে আসার গল্প

২০
X