ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসে জমে উঠেছে সরব পরিবেশ। নির্বাচনপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের তৎপরতায় বাড়ছে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া এবং দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে স্মারকলিপি প্রদানের প্রবণতা। একদিকে যেমন ভোটারদের মন জয়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অন্যদিকে প্রশাসনের টেবিলে জমা পড়ছে প্রতিদিন একাধিক স্মারকলিপি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের খাবারের দোকান, ক্যাম্পাস সংলগ্ন হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে চোখে পড়ার মতো বেড়েছে শিক্ষার্থীদের ভিড়। গাউসুল আজম মার্কেটের ‘মামা হোটেল’, বকশী বাজারের ‘পানসী রেস্টুরেন্ট’, ‘ভর্তা বাড়ি’, চানখাঁরপুলের ‘মিতালী হোটেল’ এবং ‘মামুন রেস্টুরেন্ট’ ছাড়াও বুয়েটের আহ্সান উল্লাহ হল ক্যান্টিন ও নাজিরা বাজারের বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে বিক্রিবাটায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাওয়ানোর উদ্যোগ বাড়িয়েছেন। কেউ কেউ আবার হলের ফেসবুক গ্রুপে সক্রিয় হয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। আবার অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরছেন—বিশেষ করে জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান ও বিভিন্ন আন্দোলনে ভূমিকার গল্প। যদিও কেউ কেউ এসব প্রচেষ্টাকে ‘লোক দেখানো’ বলেও মন্তব্য করছেন।
স্মারকলিপির স্রোত: নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে স্মারকলিপি প্রদানের হিড়িকও চোখে পড়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পর্যায়ে প্রতিদিন জমা পড়ছে একাধিক স্মারকলিপি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্র সংগঠন, সাধারণ শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া নানা দাবি। কেউ দিচ্ছেন ব্যক্তি উদ্যোগে, কেউবা দলীয়ভাবে।
বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে এ প্রবণতা আরও দৃশ্যমান হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর থেকে প্রতিদিন গড়ে তিন-চারটি স্মারকলিপি জমা পড়ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে।
গত ২৯ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ সংস্কার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের সুবিধা বৃদ্ধিসহ সাত দফা দাবিতে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশার কাছে স্মারকলিপি দেন একদল শিক্ষার্থী। অন্যদিকে, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও বহিরাগতদের প্রবেশ রোধে ব্যবস্থা নিতে শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের পরিচালকের কাছেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
নারী শিক্ষার্থীদের নতুন সংগঠন ‘অ্যাক্ট’ তিনটি দাবিতে উপাচার্য ও প্রক্টরের কাছে স্মারকলিপি দেয়, যার মধ্যে ছিল হলে জরুরি প্রয়োজনে অভিভাবক রাখার অনুমতির বিষয়টি। নবাগত শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন সংকট নিরসনে জরুরি ব্যবস্থা নিতে ‘ঢাবি ছাত্রশিবির’ উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেয়। একই দাবিতে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল থেকেও আলাদা স্মারকলিপি জমা পড়ে।
এটা ছাত্র রাজনীতি নয়—বলছেন বিশেষজ্ঞরা: এমন কর্মকাণ্ডকে অনেকেই নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখলেও, একে ছাত্র রাজনীতির গঠনমূলক অংশ হিসেবে মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন: ‘এটা ছাত্র রাজনীতি নয়। শিক্ষার্থীদের কমিউনিটি পলিটিক্স এখনো কেন এভাবে ম্যানিপুলেট হবে? জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমরা উৎকোচ, শক্তি প্রদর্শন ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার কথা বলি। তখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এসব কৌশল নেয়, তাহলে জাতীয় পর্যায়ে সংস্কার কীভাবে হবে?’
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের সচেতন হয়ে নিজেদের কোনোভাবে ম্যানিপুলেট হতে না দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নেতারা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের স্বার্থেই কাজ করেন। কিন্তু বাংলাদেশে খাওয়া-দাওয়া ও লোক দেখানো কাজ দিয়ে রাজনীতিকে চালনা করার একধরনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা পরিবর্তন করা জরুরি।
মন্তব্য করুন