

এক বছরের বেশি সময় আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, কিন্তু সরকারি ল্যাপটপ এখনো জমা দেননি। সেই ল্যাপটপে তিনি প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে সরকারি সব লিংক এবং ইমেইলের অ্যাক্সেস ব্যবহার করছেন। এমনকি ব্যক্তিগত গুগল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের নামে চালানো প্রোফাইল পেজে নিয়মিত ছবি ও তথ্য আপলোড করছেন।
এসব অনিয়ম ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সাবেক উপপরিচালক ডা. আবু রায়হান। অবসরে গিয়েও তিনি নিয়মিত হাসপাতালে আসেন এবং পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে কর্মীদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদান করেন।
ডা. রায়হানের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে গত ২৬ নভেম্বর হাসপাতালের স্টেনোটাইপিস্ট জেবুন নেসা জব্বার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, ২০ নভেম্বর ডা. আবু রায়হান হাসপাতালে ঢুকে তাকে ভয়ভীতি দেখান ও হুমকি দেন। এর আগেও তিনি অনেকবার হাসপাতালে এসে বর্তমান উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টারসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে একইভাবে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। এমনকি তিনি রাতে ভিডিও কল দিয়েও বিরক্ত করেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্ব পালনকালে ডা. আবু রায়হান ব্যক্তিগত ইমেইল আইডি ব্যবহার করে টিবি হাসপাতালের নামে একটি গুগল পেজ খোলেন। পেজটিতে হাসপাতালের বিভিন্ন ছবি, ভিডিও, ডকুমেন্টসহ একটি হটলাইন নম্বর দেওয়া আছে। তিনি অবসরে যাওয়ার সময় দায়িত্বভার হস্তান্তর করলেও ব্যক্তিগত ওই ইমেইল আইডি ব্যবহার করে এখনো সেই পেজে ঢুকছেন। এতে হাসপাতালের বর্তমান প্রশাসন প্রোফাইল পেজটি ব্যবহারে বিড়ম্বনায় পড়ছে।
হাসপাতাল প্রশাসন প্রোফাইল পেজটি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময় ডা. আবু রায়হানকে অনুরোধ করলেও তিনি তা এড়িয়ে যান। ২০ নভেম্বর তিনি হাসপাতালে এলে বর্তমান উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার গুগল প্রোফাইল পেজটি বন্ধের অনুরোধ জানালে তিনি স্পষ্টভাবে জানান যে, তিনি তা বন্ধ করবেন না।
একাধিক চিকিৎসক জানান, উপপরিচালক থাকা অবস্থায় তিনি অস্বাভাবিক দামে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কিনেছেন। এসব অর্থ ডা. আবু রায়হান এবং তার কথিত ভাগনে মধু আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ২০২১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা করে।
আউটসোর্সিং তালিকায় আত্মীয়স্বজন: টিবি হাসপাতালে আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে ৬৯ জন জনবলের অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনই সাবেক উপপরিচালক ডা. মো. আবু রায়হানের আত্মীয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন তার আপন ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাতিজা, ভাগনেসহ নিকটাত্মীয়রা। তারা কেউ হাসপাতালের কাজে উপস্থিত হন না, ডিউটি করেন না, তবু বছরের পর বছর বেতন উত্তোলন করছেন।
উপপরিচালক থাকা অবস্থায় অনুমোদিত আউটসোর্সিংয়ের ৪ থেকে ৫ জন কর্মীকে তিনি ব্যক্তিগত কাজে নিজের বাসায় ব্যবহার করাতেন। বাসায় কাজ করতে গিয়ে আমেনা নামে এক নারীকর্মী মারাত্মকভাবে আহত হন। এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করায় ১১ জন কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন তিনি।
ডরমিটরি দখল: তিনি হাসপাতালকে পরিণত করেছিলেন পারিবারিক সম্পত্তিতে। ব্যাচেলর চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দকৃত ডরমিটরির একটি ফ্লোর দখল করে সেখানে নিজের মা, ভাই ও বোনের পরিবারকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এমনকি অবসরের পরও এক বছর তাদের সেখানে রাখতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেন।
যন্ত্রপাতি কেনায় লুটপাট: ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল ভারী যন্ত্রপাতি কেনার জন্য। তিনি কালো তালিকাভুক্ত ঠিকাদার সাজ্জাদ মুন্সীর সাইদা এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেন। শ্বাসনালি ও ফুসফুসের অবস্থা দেখার জন্য কেনা ব্রোঙ্কস্কপি, ফ্লেক্সিবল প্লোরক্সপি এবং ১০টি নিম্নমানের আইসিইউ পেশেন্ট মনিটরের নামে ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
তিনি মহাখালীর এক ব্যবসায়িক সহযোগীর মাধ্যমে আরও ২ কোটি টাকায় ডিজিটাল এক্স-রে এবং তিনটি ইসিজি যন্ত্র কেনেন, যা জার্মানির বদলে চীন থেকে আমদানি করা হয়। এখানে লুট হয় প্রায় ১ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৬ লাখ টাকা দিয়ে একটি ভ্যাকুয়াম মেশিন কেনা হয়, যার বাজারমূল্য তখন ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। যন্ত্রটি এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
মেসার্স শাহিদা ট্রেডার্সের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকায় একটি ইনসিনেটর কেনা হয়, যার প্রকৃত মূল্য ছিল ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার মধ্যে। যন্ত্রটি জার্মানির বলে দাবি করা হলেও তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। কিনেও হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এখনো প্রিজম নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যার জন্য সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
জাল কার্যাদেশ ও জিডি: ২০২২ সালের ২০ জুলাই ডা. মো. আবু রায়হান মেসার্স গ্রিন ট্রেড নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে ৫৬ কোটি টাকার কেনাকাটায় ছয়টি কার্যাদেশ দেন। ভুয়া কার্যাদেশ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ২৮ কোটি টাকা উত্তোলন করে। বিষয়টি প্রকাশ হলে নিজের দায় এড়াতে তিনি থানায় জিডি করেন।
নিরীক্ষায় দুর্নীতি: স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির আওতায় ১০০টি স্টিলের আলমারি কেনা হয় ৯৬ হাজার টাকা দরে, যার প্রকৃত মূল্য ছিল ২০ হাজার টাকা। স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় দেখা যায়, এতে অতিরিক্ত ব্যয় ও আত্মসাৎ হয়েছে ৬৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বিধিমালা অনুযায়ী দপ্তর ব্যয় কমিটি যথাযথভাবে গঠিত হয়নি এবং দর বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
হাসপাতালে মদের আড্ডা: হাসপাতালের আঙিনায় রোজ সন্ধ্যার পর শুরু হতো মদের আড্ডা। এ আড্ডার মূল কেন্দ্র ছিলেন ডা. আবু রায়হান। তার সঙ্গে থাকত স্থানীয় সন্ত্রাসী, ঠিকাদার ও কিছু সাংবাদিক। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা বিষয়টি জানলেও ভয়ে মুখ খুলতেন না।
দুদকের অভিযোগ: ২০১৮ সালের ৫ মে মো. হাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করেন, যেখানে বলা হয় ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ডা. আবু রায়হান কেনাকাটার নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। দরপত্র আহ্বানের পর অন্য ঠিকাদারদের কাগজপত্র আটকে রেখে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতেন। এমনকি টেম্পারিং করতেন দর শিডিউলে।
ভাগনে আতঙ্ক: ডা. রায়হানের ভাগনে ‘মধু’ তার সব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী। তার দাপটে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। ভুয়া বিল, দরপত্রে অনৈতিক সহযোগিতা না করলে হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হন অনেকে। গত ছয় বছরে ‘কোটেক’, ‘ওনটেক’ ও ‘দ্য গ্লোবাল’ নামের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরপত্রে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে তিনি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
ডা. আবু রায়হানের সঙ্গে এ বিষয়ে গত এক সপ্তাহ চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তারও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেন, ‘হাসপাতালে কারা এসে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, অস্থিরতা তৈরি করে, সেটা খোঁজ নিলেই জানা যাবে।’
এক টেকনোলজিস্ট জানান, ‘তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেছে জানতে পারলেই তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা মারধর করে। এই ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না।’
মন্তব্য করুন