কুমিল্লার দাউদকান্দির নলচক এলাকার আপান দুই ভাই রুহুল আমিন এবং রেজাউল করিম। যশোরের শার্শার দুই ভাই ওলিয়ার রহমান ও নাসির উদ্দিন। একই এলাকার বাসিন্দা রমজান আলী। নিজ নিজ এলাকায় তারা ভালো মানুষ আর দানবীর হিসেবে পরিচিত; কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় তারা স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সিন্ডিকেটের হোতা। সীমান্তে ওই পাঁচজন ‘ভাই ভাই সিন্ডিকেট’ হিসেবে চিহ্নিত। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি চোরাচালানের ওই পাঁচ হোতার বিরুদ্ধে যশোরের কোতোয়ালি থানায় মামলা করলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। ঢাকার সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা দুবাই থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিমানবন্দর হয়ে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত সক্রিয়। তাদের দলের সদস্যরা দুবাই থেকে স্বর্ণ পাচার করে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে আসে। সেখান থেকে চক্রের সদস্যরা বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যায়। সীমান্ত পার করে ভারতে গৌতম নামে একজনের হাতে তা তুলে দেয়। পুরো সিন্ডিকেটের আড়ালে থাকে ওই পাঁচজন।
সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দীর্ঘ অনুসন্ধান করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ওই চক্রটির সন্ধান পায়। এরপর তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলে ওই সিন্ডিকেটকে রক্ষায় তদবির শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়ার নির্দেশে গত ১৫ জুন যশোরের কোতোয়ালি থানায় ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পক্ষ থেকে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। মামলায় ওই পাঁচজন ছাড়াও তাদের সহযোগী দাউদকান্দির মো. শাহজালাল, চাঁদপুর মতলব উত্তরের আরিফ মিয়াজী, মাদারীপুরের আবু হায়াত জনি, নারায়ণগঞ্জের রবিউল আলম রাব্বি, বেনাপোলের জাহিদুল ইসলাম ও নাজমুল হোসেনকে আসামি করা হয়।
মামলায় বলা হয়েছে, এই চক্রটি গত তিন বছরে স্বর্ণ পাচার করে ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৫২ হাজার টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছে। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছে।
গরুর খাটালের আড়ালে স্বর্ণ পাচার : সিআইডির মামলায় বলা হয়েছে, দুই ভাই রুহুল আমিন ও রেজাউল করিম মূলত দুবাই থেকে স্বর্ণ পাচার করে দেশে আনে। এরপর তারা বেনাপোলে সিন্ডিকেটের সদস্য অপর দুই ভাই ওলিয়ার রহমান ও নাসির উদ্দিন এবং রমজান আলীর কাছে পৌঁছে দেয়। ওই তিনজন মূলত বেনাপোল সীমান্তে গরু ব্যবসার নামে খাটাল স্থাপন করেছে। ওই খাটালের আড়ালে এরা বেনাপোল স্থলবন্দর ও পোর্ট বাগান দিয়ে স্বর্ণ পাচার করে থাকে।
সিআইডির মামলায় বলা হয়, এই চক্রটি শুধু স্বর্ণ চোরচালানকারীই নয়, এরা দেশে অবৈধ ডলার বাণিজ্যের সঙ্গেও যুক্ত। চক্রটি পাচার করা স্বর্ণের বিনিময়ে অবৈধপথে ডলার পাচার করে দেশে নিয়ে আসে।
যেভাবে শনাক্ত ভাই ভাই সিন্ডিকেট : সিআইডি সূত্র জানায়, গত বছরের জুনে পাচারের সময় বেনাপোল সীমান্তে ১৩৫টি স্বর্ণবারসহ আটক হয় বাহক নাজমুল, রাব্বি, জনি, আরিফ মিয়াজী, জাহিদুল ও শাহজালাল। ওই ঘটনায় দায়ের মামলাটি তদন্ত করে সিআইডির যশোর অফিস। এতেই বেরিয়ে আসে ওই স্বর্ণের প্রকৃত মালিক রুহুল আমিন, রেজাউল করিম, ওলিয়ার রহমান, নাসির উদ্দিন ও রমজান আলী। তদন্তে এদের মানি লন্ডারিংয়ের তথ্যও উঠে আসে। এরপর যশোর সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি সদর দপ্তরে এই চক্রের মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য চিঠি দেন। পরে ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট অনুসন্ধানে নেমে স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডিতে ডলার লেনদেন, নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের সম্পদের মালিক হওয়া এবং মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হয়।
ওই ঘটনায় দায়ের মামলাটি তদন্ত করছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক সাইদুর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের মামলাটির তদন্ত দায়িত্ব পেয়েছেন দুদিন আগে। তিনি এখনো নথি যাচাই করছেন। ওই মামলার ৬ আসামি গত বছরই চোরাচালানের স্বর্ণসহ হাতেনাতে ধরা পরে কারাগারে রয়েছে। এদের হোতা পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মন্তব্য করুন