হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ তিনি। নাম ময়েজ উদ্দিন। এই কলেজের মার্কেটে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন আল আজাদের ৯টি দোকান রয়েছে। সেগুলো দখলের চেষ্টা করেছেন অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিন। অপরাধের এখানেই শেষ নয়, এ কাজে তিনি ঢাকা-১৪ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের সইও জাল করেছেন। তার এই অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তেও। এরই মধ্যে তদন্ত শেষ করে সিআইডির ঢাকা মেট্রো-পশ্চিম বিভাগের উপপরিদর্শক মো. শফিউল্লাহ রায়হান আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আর ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ডিএমপির শাহ আলী থানা পুলিশকে।
সই জাল করে তৈরি করা দুটি চিঠির কপি এসেছে কালবেলার হাতে। একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলাউদ্দিন আল আজাদকে। অন্যটি দেওয়া হয়েছে মো. বাবুল মাতুব্বর নামে এক ব্যক্তিকে। এই বাবুল মাতুব্বর মো. আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাড়াটিয়া। হযরত শাহ আলী কলেজ মার্কেটের তৃতীয় তলায় ১ হাজার ৫২৬ বর্গফুট আয়তনের ৯টি দোকানের মালিক আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাকে দেওয়া চিঠিতে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ২৪ মাসের ভাড়া বাবদ ১৭ লাখ ২১ হাজার ৫১৭ টাকা দাবি করা হয়। দুটি চিঠিই ইস্যু করা হয় ২০২০ সালের ২৫ জুলাই। এরপর একই বছরের অক্টোবর মাসে মো. আবুল সরকার নামে এক ব্যক্তি দোকানে গিয়ে ‘অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিন পাঠিয়েছেন’ জানিয়ে দোকানের ভাড়াটিয়াদের হুমকি-ধমকি দেন। সেইসঙ্গে ওইসব দোকান নিজের বলে দাবি করেন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ী নেতাদের মাধ্যমে মো. আবুল সরকারকে কাগজপত্র নিয়ে ডাকলে তিনি আর সেখানে জাননি। পরে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি সমঝোতা হয়। আর আবুল সরকার ওই দোকানের দাবি ছেড়ে দেন। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিন শাহ আলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন আল আজাদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ২০১২ সালে মার্কেটের জায়গা ক্রয় করি। এরপর ময়েজ উদ্দিন এমপির স্বাক্ষর জাল করে আমাকে চিঠি দেন। চিঠি পেয়ে প্রথমে আমি ভয় পেয়ে যাই। পরে এমপির সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এমপির সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানান, আসলামুল হক ওই স্বাক্ষর করেননি। পরে এমপি ময়েজ উদ্দিনকে ডাকবেন বলে জানিয়েছিলেন আমাকে। এর মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। এরপর আমি আদালতে মামলা করি।
জানা যায়, মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। সিআইডির দীর্ঘ তদন্তে সেই জালিয়াতির প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিরিন আক্তারের সই নকল করে জাল দলিল বানিয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদের দোকান দখল চেষ্টার প্রমাণ পাওয়া যায় সিআইডির তদন্তে। এরপর সিআইডির উপপরিদর্শক মো. শফিউল্লাহ রায়হান আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। তদন্ত প্রতিবেদনে সিআইডি জানিয়েছে, আসলামুল হকের নামে দেওয়া ‘খ ও খ-১’ অনুস্বাক্ষর দুটি স্ক্যানকৃত জাল স্বাক্ষর। আর অধ্যক্ষ শিরিন আক্তার নামীয় ‘গ, গ-১ থেকে গ-৪’ অনুস্বাক্ষর দুটি স্ক্যান করা জাল স্বাক্ষর। সিআইডির প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, দুটি স্বাক্ষরের নিচে যে তারিখ লেখা রয়েছে, সেটিও একই ব্যক্তির দেওয়া। দুটি লেখার মধ্যকার ৯টি বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায় বলেও ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়।
ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আদালত গত ৩০ জানুয়ারি অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তবে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিনকে। জানতে চাইলে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের কাছে অফিসিয়ালি এখনো ওই ওয়ারেন্টটি এসে পৌঁছায়নি। তবে বাদীপক্ষ একটি ওয়ারেন্টের ফটোকপি নিয়ে থানায় এসেছিল। আমরা অফিসিয়ালি ওয়ারেন্টটি পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়েও তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। এমপির স্বাক্ষর জালিয়াতি করেছেন কি না—এমন প্রশ্নে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।
এদিকে এ ঘটনায় অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিনকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কলেজ গভর্নিং বডি। হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি রেগুলেশন (সংশোধিত) ২০১৯’-এর সর্বশেষ (অক্টোবর ২০২৩) সংশোধিত বিধির ১৭ ধারা ক(২), ক(৩), ক(৬), ক(৭), ক(৯) অনুযায়ী পেশাগত অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনের দায়ে আপনাকে (ময়েজ উদ্দিন) চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সেইসঙ্গে তাকে স্থায়ী বরখাস্ত করতে অভিযোগগুলো অধিকতর তদন্তের জন্য গভর্নিং বডি তদন্ত কমিটি করেছে বলেও ওই চিঠিতে জানানো হয়।