দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় আমদানিনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আমদানি থেকে বের হতে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে। এজন্য স্থলভাগে একশ কূপ খনন করা হবে। পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে সরকার।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে চাহিদামতো জ্বালানি বিশেষ করে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। একই কারণে জ্বালানির বিলও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। আমদানি করা প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘনফুট) এলএনজির দাম দেশীয় গ্যাসের চেয়ে ৫৫ টাকা বেশি। মোট চাহিদার মাত্র ২৩ শতাংশ আমদানি করতে বছরে কমবেশি ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিয়ে আগামী চার বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে আমরা চাহিদার ২৩ শতাংশ এলএনজি আমদানি করছি। এতে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে খরচটা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে গ্যাস পাচ্ছি, এর প্রতি ইউনিটের দাম পড়ছে ৪ টাকা। আর আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে ৬০ টাকার মতো।
দেশের গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি করতে ২০২৮ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে একশ কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশে গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়বে। এজন্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি পেট্রোবাংলা ২০২৮ সালের মধ্যে মোট ১০০ কূপ খননের নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে।
এর মধ্যে বাপেক্স ৬৮টি, সিলেট গ্যাসফিল্ড ১১টি ও বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড ২১টি কূপ খনন করবে। এর মধ্যে নতুন কূপ হবে ৬৯টি, বাকিগুলো বন্ধ কূপ, যা সংস্কার (ওয়ার্কওভার) করা হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের পক্ষে এককভাবে এতগুলো কূপ খনন করা সম্ভব নয়। যে কারণে কূপ খনন ও সময় বাঁচাতে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে পাঁচটি ও চীনের বহুজাতিক কোম্পানি সিনোপ্যাককে পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি বিশেষ বিধানের আওতায় এই কাজ দেওয়া হবে বলে পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, গ্যাজপ্রমকে দেওয়া হবে ভোলার শাহবাজপুর-৫, শাহবাজপুর-৭, শাহবাজপুর নর্থ-ইস্ট-১, ভোলা নর্থ-৩ এবং ভোলা নর্থ-৪ কূপের কাজ। এর মধ্যে শাহবাজপুর নর্থ-ইস্ট অনুসন্ধান কূপ এবং বাকি চারটি উন্নয়ন কূপ। সিনোপ্যাক খনন করবে রশিদপুর-১১, রশিদপুর-১৩, সিলেট-১১, কৈলাসটিলা-৯ এবং ঢুপিটিলা-১ কূপ। এগুলোর চারটি অনুসন্ধান ও একটি উন্নয়ন কূপ। এ ছাড়া ইউরোপভিত্তিক আরও দুটি কোম্পানিও স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখিয়েছে।
এর আগে ঘাটতি মেটাতে ২০২৫ সালের মধ্যে সরকার ৪৮টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়। এর মাধ্যমে দৈনিক ৬১ দশমিক ৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়ার আশা করা হয়। এখন পর্যন্ত ১১টি কূপ খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কূপ শুষ্ক পাওয়া যায়। একটির গ্যাস উত্তোলন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়। বাকি কূপগুলো থেকে দিনে ১২ দশমিক ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা বেড়েছে। তবে পাইপলাইনে যোগ হয়েছে মাত্র ৪ কোটি ঘনফুট। আর বর্তমানে তিন কূপের ওয়ার্কওভারের কাজ চলছে।
অন্যদিকে, মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশও বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড থেকে উৎপাদন বাড়াতে নতুন কূপ খনন করছে। ইতোমধ্যে বিবিয়ানা-২৮ কূপ খননের কাজ শেষ হয়েছে। আর বিবিয়ানা-২৭-এর কাজ চলছে। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে।
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সিলেট অঞ্চলে মজুত সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এককভাবে বিবিয়ানার মজুত সর্বোচ্চ। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত (টুপি) গ্যাসের মজুত ৫ হাজার ৭৫৫ বিসিএফ (প্রায় ৬ টিসিএফ)। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে ৫ হাজার ৫০১ বিসিএফ (সাড়ে ৫ টিসিএফ)। আর সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতায় থাকা পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রে মজুত প্রায় সাড়ে চার টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। আর ভোলা দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গ্যাস মজুতের এলাকা। এখন পর্যন্ত ভোলায় গ্যাস মজুত দুই টিসিএফ, যা আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এ ছাড়া গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। এরই মধ্যে দরপত্রে অংশ নিচ্ছে দুই মার্কিন কোম্পানি শেভরন ও এক্সনমবিল। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদের শেষের দিকে এক্সনমবিল বিশেষ আইনে সাগরের ১৫টি ব্লকে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। তবে সরকারের নতুন মেয়াদে এক্সনমবিলের সঙ্গে বৈঠকে জ্বালানি বিভাগ থেকে কোম্পানিটিকে উন্মুক্ত দরপত্রে অংশ নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া চীনের তিনটি কোম্পানি গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রাথমিকভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রের অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি)-২০১৯ সংশোধন করা হয়েছে। গত বছরের ২৬ জুলাই ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দেয় সংশোধিত পিএসসি-২০২৩। নতুন পিএসসিতে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের (জ্বালানি তেল) বাজারদরের সঙ্গে ওঠানামা করবে গ্যাসের দর। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৮০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৮ ডলার।
এ ছাড়া নতুন পিএসসিতে উৎপাদিত গ্যাসের ভাগাভাগিতেও ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। পিএসসির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জির পরামর্শ অনুযায়ী এতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন পিএসসিতে এই ভাগাভাগি উভয়পক্ষে সমান শতাংশে ভাগ করে পাবে। তবে ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ের দুই বছরের মধ্যে কূপ খনন করে গ্যাস না পেলে কিংবা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য না হলে শর্তসাপেক্ষে যথাক্রমে ১ ও ২ শতাংশ হিস্যা বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রে প্রথম প্রস্তাব পেট্রোবাংলাকে দিতে হবে, পেট্রোবাংলা নিতে না চাইলে তৃতীয়পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুযোগ পাবে বিদেশি কোম্পানি।