‘আমার সাড়ে ৬ বছরের মেয়েটা একটু পরপর এসে শুধু বলে, বাবা কী ঈদের আগে আসবে নাকি পরে। আমার ঈদের জামাটা আগেই পাঠিয়ে দিতে বলো। আগে তো ঈদের আগেই আব্বু জামা-কাপড়, জুতা কত কিছুই দিত। এবার কখন দেবে। আমি মেয়েকে কোনো উত্তর দিতে পারি না। আড়াই বছরের ছেলেটা শুধু তার বাবাকে খোঁজে। বাবাকে আর খুঁজে পায় না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোবাইলে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জুয়েল গাজীর স্ত্রী রেবা আক্তার।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় নিহত হন জুয়েল গাজী। তিনি চাকরি করতেন ওই ভবনের সাততলায় অ্যামব্রোসিয়া রেস্তোরাঁয়। সেখানকার সেকেন্ড শেফ ছিলেন তিনি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও তিনি ছিলেন কর্মক্ষেত্রে বাস্ত। কিন্তু ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সব শেষ হয়ে গেছে। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় তিনিই ছিলেন সকলের ভরসা। তাকে হারিয়ে এখন চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে পরিবারটি।
রেবা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ে তাসলিমা আক্তার জুয়েনা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। ছেলে সাইফুর রহমান তাহমিদের বয়স আড়াই বছর। বাচ্চা দুটি বাবার আদর কী জিনিস বোঝার আগেই এতিম হয়ে গেল। আমাদের জীবনে আর কোনো ঈদ আনন্দ নেই। ঘটনার পর আমাদের সঙ্গে কেউ কোনো যোগাযোগ করেনি। অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছি। পটুয়াখালীর মধুপুর গ্রামে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে আছি। আমার স্বামীই তো একমাত্র কর্মক্ষম ছিলেন। আমি তো গৃহিণী। সব খরচ তিনিই চালাতেন। ছেলেমেয়ে দুটি বারবার তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। কিছুই বলতে পারি না। আমাদের জীবনে কী হবে, কিছুই জানি না। এই সন্তান দুটোকে কীভাবে মানুষ করব, সেটাই এখন প্রশ্ন।’
ওই ভবনেই আফেরান জুস বারে শেফ হিসেবে কাজ করতেন মেহেদী হাসান (২৭)। সেদিনের আগুনের ঘটনায় প্রাণ হারান কৃষক বাবা মোয়াজ্জেম মিয়া এবং গৃহিণী মা কল্পনা বেগমের বড় সন্তান মেহেদী। পরিবারে সচ্ছলতা আনতে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসে কাজ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সব শূন্য করে চলে গেলেন। মেহেদীর ছোট ভাই মো. ইসরাফিল মিয়া বলেন, ‘আমিও ওখানে ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতাম। ঘটনার দিন আমি দৌড়ে ছাদে উঠতে পারলেও আমার ভাই পারেনি। সে সেখানেই প্রাণ হারায়।’
কষ্ট আর হাহাকার নিয়ে ইসরাফিল বলেন, ‘আমাদের জীবনে আর ঈদ কী। আমার বাবা কৃষিকাজ করেন, মা গৃহিণী। পরিবারের একটু সচ্ছলতার জন্য আমরা ঢাকায় গিয়েছিলাম। এখন আমি আবার বাড়িতে চলে আসছি। বাবা-মাকে তো দেখা লাগবে। আমাদের জীবনে কোনো ঈদের আনন্দ নেই, সব আনন্দ মাটি।’
এই ঈদে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাবেন বলে পড়াশোনার পাশাপাশি আলাদা চাকরি নিয়েছিলেন আশরাফুল ইসলাম আসিফ (২৫)। বাবা মো. জহুরুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর আপন বড় ভাই মো. তারেকের সঙ্গে থাকতেন উত্তর গোড়ান এলাকায়। কাজ করতেন গ্রিন কোজি কটেজের তিনতলায় ইলিয়ন শপে। ইচ্ছা ছিল নিজের হাতখরচ নিজেই চালাবেন, আর ঈদে ঘুরতে যাবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুড়ে গেছে আগুনের লেলিহান শিখায়।
তারেক বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে ঘরে বসে থাকতে চায়নি আসিফ। তার খুব ইচ্ছা ছিল তার চাকরির জমানো টাকা দিয়ে এবারের ঈদে ঘুরতে যাবে। ঈদ তো এলো; কিন্তু আমার ভাই আর নেই। আমাদের ঘরেও ঈদ নেই।’
কথা হয় বেইলি রোডে নিহত আরও পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে। সবার কণ্ঠেই ঝরেছে বিষাদ আর হাহাকার। স্বজনদের স্মরণে শুধু গত ঈদের স্মৃতি। নিহতদের সবার পরিবারই জানিয়েছে, এই ঘটনার পর তাদের সঙ্গে সরকারিভাবে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। কেউ কোনো আর্থিক সহযোগিতাও পায়নি। এই আগুনের ঘটনা কেন ঘটল, কারা দায়ী, জড়িতদের কোনো বিচার হবে কি না, সেটাও জানেন না তারা।