শিতাংশু ভৌমিক অংকুর
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৫ এএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রার্থনা শোকাচার

বৃষ্টি নামুক ঊষর জমিনে

বৃষ্টি নামুক ঊষর জমিনে

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহে বিপর্যয় নেমে এসেছে প্রাণ-প্রকৃতিতে; ফসলের মাঠ হয়ে উঠেছে বিবর্ণ। জলাশয় শুকিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির। এ অবস্থায় একটু বৃষ্টি না হলে মরুর হাহাকার নেমে আসবে সবুজ-শ্যামল বাংলার প্রকৃতিতে। এই বৃষ্টির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস থেকে প্রার্থনাসহ নানা লোকাচার পালন করছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাঙের বিয়ে, ইসতিসকার নামাজ, তালতলার শিরনি, মেঘ পূজা, হুদমা গান, কুলা নামানি, পুণ্যিপুকুর ব্রতসহ নানা আয়োজন।

ইসতিসকার নামাজ: ‘ইসতিসকা’ শব্দের অর্থ পানির জন্য প্রার্থনা করা। খরা বা তাপদাহের অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে আল্লাহর কাছে তওবা করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আকুতি ভরে বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে হয়। এই নামাজকে ইসতিসকার নামাজ বলে। পরপর তিন দিন ইসতিসকার নামাজ পড়া সুন্নত। যদি এরই মধ্যে বৃষ্টি হয়ে যায়, তবু তিন দিন করা উত্তম। এই তিন দিন নফল রোজা রাখা মুস্তাহাব। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের মাঠের দিকে বের হয়ে গেলেন, অতঃপর ইসতিসকা (আল্লাহর কাছে পানি তলব) করলেন। তিনি কিবলামুখী হলেন। তার চাদর উল্টিয়ে পরলেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

ইসতিসকার নামাজের সময়: সূর্যোদয়ের পর ২০ মিনিটের মতো অতিবাহিত হলে ইসতিসকার নামাজ পড়তে হয়, ইশরাক নামাজ ও ঈদের নামাজের সময়ের মতো।

ব্যাঙের বিয়ে: ‘ব্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গির বিয়ে, কুলো মাথায় দিয়ে/ও ব্যাঙ জল আন গিয়ে আন গিয়ে/খালেতে নাই জল/বিলেতে নাই জল/আকাশ ভেঙে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল।’ এমনটাই গাইতে গাইতে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয় কোনো বিল বা জলাশয় থেকে ধরে আনা একজোড়া ব্যাঙকে। ব্যাঙের মাথায় থাকে টোপর, নারীরা শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে ব্যাঙের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দেন। বিয়ে উপলক্ষে চলে ভূরিভোজও।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টির দেবতা বরুণ দেব সন্তুষ্ট হয়ে শিগগির পর্যাপ্ত বৃষ্টি নামাবেন এবং ওই বছর ধানের উৎপাদন ভালো হবে। অনাবৃষ্টি ও খরার দরুণ দেশের নানা অঞ্চলে আজও ব্যাঙের বিয়ে মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই নয়, ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয় পাহাড়ি সমাজেও। অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ব্যাঙের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদার মতো সবজি ও চাল সংগ্রহ করে। এরপর বিয়ের আয়োজনকারী বাড়ি গোবর দিয়ে লেপে পবিত্র করে ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয়। আয়োজন শেষে মহাধুমধামের মাধ্যমে খাবার পরিবেশন করা হয়।

তালতলার শিরনি: বাংলার কৃষিপ্রধান অঞ্চলে তালতলার শিরনি বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি আয়োজন। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ, চাল, গুড় চাঁদা হিসেবে তোলা হয়। কেউ কেউ অর্থ সাহায্যও করেন। সংগৃহীত রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের সবচেয়ে উঁচু গাছের তলায়। এরপর হাঁড়িতে চড়িয়ে রান্না করা হয় শিরনি।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উঁচু গাছ তালগাছ হওয়ায় এটি তালতলার শিরনি হিসেবেই পরিচিত। অনেক অঞ্চলে খিচুড়িকেও শিরনি নামে ডাকা হয়। তালতলায় শিরনি খাওয়ার জন্য গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ গাছতলায় জড়ো হয়। রান্না শেষে উপস্থিত গ্রামবাসীকে কলাপাতায় শিরনি বিতরণ করা হয়। খাওয়ার পর উপস্থিত গ্রামবাসী বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন।

কাদা মাখানো: কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টি নামানোর জন্য কাদা মাখানোরও চল রয়েছে। মেয়েরা পানিভর্তি কলসি নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। তারা শুকনো উঠানে পানি ঢেলে কাদা তৈরি করে একে অন্যের গায়ে তা ছিটিয়ে দেয়।

মেঘ পূজা: উত্তরবঙ্গে অনাবৃষ্টির সময় বৃষ্টি নামানোর জন্য লোকজ পূজার নাম হুদুমদ্যাও পূজা বা মেঘ পূজা। এ উপলক্ষে নৃত্য-গীতেরও আয়োজন করা হয়। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখ মাসের শুরুতে এই লোক পূজা হয়ে থাকে। ফিঙে পাখির বাসা, কলাগাছ, পানিভর্তি একটি ঘট, কুলো, পান-সুপারি, বরণ ডালা, ধূপ এবং পূজার নানাবিধ সরঞ্জাম নিয়ে হুদুমদ্যাও পূজার আয়োজন করা হয়। মেঘ পূজায় পুরুষদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এটি নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

হুদমা গান: বৃষ্টি নামানোর জন্য জনজাতির মানুষজন রাতে দল বেঁধে হুদমা গান গেয়ে থাকেন। তাদের বিশ্বাস, হুদমা মেঘের দেবতা। যদি দেবতা হুদমাকে সন্তুষ্ট করা যায়, তাহলে তিনি চাষের উপযুক্ত বৃষ্টি বর্ষিত করবেন।

কুলা নামানি: গ্রাম বাংলায় বৃষ্টির জন্য কৃষকদের এক লোকজ অনুষ্ঠানের নাম কুলা নামানি। প্রথমে নতুন একটি কুলায় ধান, বিভিন্ন বনফুল, দূর্বাঘাস এবং কাকের বাসার কাঠখড় দিয়ে সাজানো হয়। গ্রামের কোনো এক কিশোর বা কিশোরীর মাথায় সেই কুলা তুলে দেওয়ার আগে একটি কাঁসার কলসির ওপর কুলাটি রাখা হয়। কলসিতে থাকে সোনা-রুপা ভেজানো পানি। সঙ্গে থাকে একটি আমগাছের ডাল। কুলা বহনকারী সেই কিশোর/কিশোরীর মুখে মাখানো থাকে সাদা চুন ও কালি। এ চুন-কালি মেঘের প্রতীক। কুলা বহনকারীর পেছনে সারিবদ্ধভাবে আসতে থাকে বাকি কিশোর, বালকরা। তাদের মুখেও চুন-কালি থাকে। কুলা নামানির দলের সঙ্গে থাকেন কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ গ্রামবাসীও। কুলা নামানি বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চাল, ডাল, তেল-মসলা, শাকসবজি বা টাকা-পয়সা চাঁদা হিসেবে তোলে। তাদের জিনিসপত্র দেওয়ার সময় বিভিন্ন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা কুলা নামানির দলকে দিয়ে ভিজিয়ে দেন। তখন সবাই বৃষ্টির গান ধরে বৃষ্টি নামানোর জন্য প্রার্থনা করেন। এমনই একটি গান ‘আল্লাজিরা, তেওল্লাজিরা, বাঁশপাতার ভাই/এমন বরণ বইরা যাবি ভিজ্জা বাড়ি যাই।’ গান গাইতে গাইতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগৃহীত চাল, ডাল ও জিনিসপত্র নিয়ে কোনো এক বাড়ির উঠানে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করা হয়। রান্নার সময়ও উপস্থিত সবার মুখে মুখে থাকে বৃষ্টির গান। খিচুড়ি রান্না শেষে তা আগত সবাইকে খেতে দেওয়া হয়।

পুণ্যিপুকুর ব্রত: গ্রাম বাংলায় বৃষ্টি নামানোর আরেকটি প্রথা ‘পুণ্যিপুকুর ব্রত’। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আচার। বৃষ্টি নামানোর পাশাপাশি বৃষ্টির অভাবে এবং তীব্র সূর্যতাপে যেন পুকুর না শুকিয়ে যায়, গাছপালা না মারা যায় এবং ফসলের ফলন ভালো হয়—সেজন্য এক মাসব্যাপী এই ব্রত পালন করা হয়। ৫ থেকে ৯ বছরের মেয়েরা এই ব্রত পালন করে থাকে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে বিবাহিত নারীরাও অংশ নেন ব্রতে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অফিসার নেবে রহিমআফরোজ, আবেদন করুন সময় থাকতে

পঞ্চম আন্তর্জাতিক ডেন্টাল সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত

রসগোল্লায় ভাগ্য খুলেছে শরিফের

বিদেশে বসেই প্রেমিককে হত্যার ছক আঁকেন নাজমা

ভোট দিতে না পারলে নির্বাচনের দরকার নেই : মির্জা আব্বাস

প্রবাসে ফেরা হলো না আলমগীরের, সড়কে ঝরল ৩ প্রাণ 

চুক্তিভিত্তিক অ্যাডমিন অফিসার নিচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট, বেতন ৪৩ হাজার

নাম পরিবর্তন করেও ধরা খেলেন মিজানুর

সুদানে ক্ষুধায় বহু মানুষ মারা যেতে পারে : জাতিসংঘ

প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে ফুলবাড়ীতে পুড়ছে ক্ষেতের ফসল, দুশ্চিন্তায় কৃষক

১০

গোয়েন্দা জেরার মুখোমুখি হচ্ছেন মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী

১১

সুজনকে পিটিয়ে হত্যা ঘটনায় বাবা ও ভাই গ্রেপ্তার

১২

এমপিদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীদের সরে আসার আহ্বান ইসি রাশেদার

১৩

এক সিগারেটের আগুনে পুড়ল ১০০ বিঘা পানের বরজ

১৪

মিথিলার অর্জন

১৫

ব্র্যাক ব্যাংকে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ, আবেদনে নেই বয়সসীমা

১৬

আসামি ধরতে গিয়ে পরিবারের হামলায় ৩ পুলিশ সদস্য আহত

১৭

আদালত অবমাননায় আলালকে হাইকোর্টে তলব, রুল জারি

১৮

বৃষ্টি বাড়বে যেদিন থেকে

১৯

বাজারে ‘হালাল’ পানীয় আনছেন মেসি

২০
*/ ?>
X