আইন অমান্য করে সিমপ্লেক্স ডেভেলপারস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর কাফরুলে একের পর এক নির্মাণ করে চলেছে ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল আবাসিক ভবন। আদালতের নিষেধাজ্ঞা পরও নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ উঠেছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউকের) কিছু অসাধু কর্মকর্তা এ প্রতিষ্ঠানটিকে গোপনে সহায়তা করছেন। প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েক বছর ধরে নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। রাজউকের ইমারত আইন অমান্য করে শুধু রাজধানীর কাফরুল এলাকায় সম্প্রতি ৯টি ভবন নির্মাণ করেছে এই প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া এলাকাটির অলিগলিতে রয়েছে তাদের অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। এসব ভবনের পাশের রাস্তাগুলো খুবই সরু। এখানে অগ্নিকাণ্ড বা কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকারীদের গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না। এতে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা স্থানীয়দের।
জানা গেছে, আদালত এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়ার এক বছর পার হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন করেনি রাজউক। জানতে চাইলে রাজউকের (জোন-৩) পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার প্রথমে বিষয়টি অনেক পুরোনো বলে এড়িয়ে যান। দুদিন পর কালবেলাকে তিনি মোবাইল জানান, ইচ্ছা করলেই রাজউকে পুলিশ পাওয়া যায় না। মাসে সাধারণত আমরা তিনটি অভিযান পরিচালনা করি। চেয়ারম্যানের অনুমতি পেলে আগামী মাসে হয়তো কাফরুলে অভিযান পরিচালনা করব। এরই মধ্যে আমরা তাদের মৌখিকভাবে কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি। কিছুদিন বন্ধও ছিল। এখন যদি আবার শুরু করে থাকে তাহলে তারা অপরাধ করছে।
প্রসঙ্গত, রাজউকের এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পরিচালক (প্রশাসন) স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অনিয়মের তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই প্রতিবেদনের কোনো খবর নেই।
জানা যায়, ২০২১ সালে কাফরুল থানাধীন দক্ষিণ কাফরুলের সেনপাড়া পর্বতা মৌজার ৪৪৬ নম্বর হোল্ডিং রাজউক অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। জানতে পেরে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয় রাজউক। কিন্তু এ নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে সিমপ্লেক্স। পরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর রাজউকের পক্ষে রায় দেন। এতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি এক মাসের মধ্যে নিজ খরচে নির্মাণাধীন ভবনটি ভেঙে ফেলবে। যদি তা না হয় রাজউক ভবনটি ভাঙবে। এ ভাঙার খরচ দেবে সিমপ্লেক্স। কিন্তু আদালতের এ নির্দেশ অমান্য করা সিমপ্লেক্স আন্ডারগ্রাউন্ড বেজমেন্ট ছাড়াও ৯তলা ভবন নির্মাণ করে।
সরেজমিন দেখা যায়, এ ভবনে ২৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে একটি ছাড়া বাকি ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এ ছাড়া উত্তর কাফরুল এলাকার ৫৪৯, ৫০৭ ও ৪৪৪ নম্বর হোল্ডিং, ইব্রাহিমপুর কাফরুল ৭৬৭ নম্বর হোল্ডিং, দক্ষিণ কাফরুলে ২৯৬/১ হোল্ডিং, একই এলাকার ৪৫২ ও ৫৪১ নম্বর হোল্ডিংয়ে রাজউকের অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ ছাড়া ২০২২ সালে কাফরুলে ২২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে অনুমোদিত নকশা ছাড়া ভবন নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানটি। রাজউকের লোকজন সেখানে গেলে সিমপ্লেক্স তাদের নকশা দেখাতে ব্যর্থ হয়। এ ঘটনায় রাজউক নোটিশ দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি সিমপ্লেক্স।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন থানা ও আদালত সূত্রে জানা যায়, সিমপ্লেক্স ডেভেলপারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ছাড়াও প্রতারণা করে অর্থ আদায় ও জোরপূর্বক জমি দখলের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলা ও বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নাহিদ রহমান নামে এক নারী ২০২২ সালের ২০ জুলাই উত্তরা পূর্ব থানায় একটি জিডি করেন। এতে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২২ মার্চ সিমপ্লেক্স ডেভেলপারস লিমিটেডের সঙ্গে ভবন নির্মাণের চুক্তি করেন তিনি। যার আমমোক্তার নামা দলিল-৪৫৪৯। এরপর প্রতিষ্ঠানটি তার জমির ওপরে ১০তলা ভবন নির্মাণ শুরু করে। কিছুদিন পর সেখানে গেলে ওই নারীকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ওই নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
এর আগে সেখানে জমিটি দেখভালের জন্য ওই নারীর নিযুক্ত কেয়ারটেকার মো. সাঈদ মিয়াকে সিমপ্লেক্সের কর্মীরা মারধর করে সেখান থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনায় কেয়ারটেকার মো. সাইদ ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আইন মেনেই ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। রাজউকের নির্দেশে কিছু ভবন ভাঙা হয়েছে। বিষয়টি রাজউকের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি লড়াই চলছে। এসবের প্রমাণ চাইলে তিনি ঢাকার বাইরে আছেন বলে লাইন কেটে দেন।
এসব অনিয়ম সম্পর্কে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, আগে কী হয়েছে বলতে পারব না। তবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা এক নতুন ঢাকাকে পরিচয় করিয়ে দেব। যেখানেই অবৈধ স্থাপনা পাওয়া যাবে, সেখানেই রাজউকের উচ্ছেদ অভিযান চলবে। এ বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা কামনা করেছেন।