বিশ্ব মুসলিমের বছরে দুটো জাতীয় উৎসবের একটি কোরবানি। কোরবানি যেমন আনন্দ উৎসবের, তেমনি ইবাদতেরও। হিজরি ক্যালেন্ডারের জিলহজ মাসের ১০ তারিখ পালন করা হয় এ উৎসবমুখর ইবাদত। ঈদের নামাজ, পশু কোরবানি, তাকবির প্রদানসহ বিভিন্ন আমল রয়েছে এদিন। তবে ঈদুল আজহার সবচেয়ে বড় আমল হলো আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করা। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহ পরীক্ষা করেনÑবান্দা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তার রবের জন্য। একই সঙ্গে সামর্থ্যবান ব্যক্তির সম্পদ থেকে পশু কোরবানির মাধ্যমে গরিবের ঘরেও আনন্দ বিলানোর ব্যবস্থা করেন আল্লাহ। তাইতো বিধান হয়েছে, কোরবানির গোশত মালিক একা খাবেন না, পাড়া-প্রতিবেশী অসহায়-গরিবকেও দিতে হবে। কোরবানির গোশত তিন ভাগ করা সুন্নত। এক ভাগ নিজের পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-প্রতিবেশীদের জন্য, আরেক ভাগ অসহায়-গরিবের জন্য। এভাবেই কোরবানি মুসলিম সমাজে উদ্যমতা তৈরি করে। ধনী-গরিবের পার্থক্য মিটিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে। ঈদের খুশিতে আন্দোলিত করে তোলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে।
কোরবানি মূলত ত্যাগের পরীক্ষা। এর মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা দেখেন না তোমাদের সম্পদ, দেখেন না তোমাদের বেশভূষা, দেখেন শুধুই তোমাদের অন্তর আর আমলে পরিশুদ্ধতা।’ (মুসলিম: ২৫৬৪)। অন্য হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈদুল আজহার আমলগুলোর মধ্যে কোরবানি করার চেয়ে অন্য কোনো আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। কেয়ামতের দিন কোরবানির এ পশুকে তার শিং, পশম, খুরসহ সবকিছু উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে (কোরবানি) কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করো।’ (তিরমিজি: ১৪৯৩)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের গোশত আর না তাদের রক্ত, বরং তার কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।’ (সুরা হজ: ৩৭)। তাই কোনো বান্দা যদি লোকদেখানো বা গর্ব করার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে কোরবানি দেয়, এতে তার সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের পাল্লা ভারী হবে। তাই সর্বাগ্রে নিয়তের শুদ্ধতা চাই। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কোরবানি করা চাই।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা তথা কোরবানি করা থেকে কোনো আমলই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। নিশ্চয়ই কোরবানির পশু কেয়ামতের দিন তার শিং, চুল, খুরসহ উপস্থিত হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। সুতরাং তা দ্বারা নিজেকে সুবাসিত ও সুরভিত করো।’ (তিরমিজি: ১/২৭৫)। অন্য বর্ণনায় আছে, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে সওয়াব দেওয়া হবে। (তিরমিজি: ১/২৭৫)।
কোরবানির ঈদে মুসলমানের আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের পরীক্ষা হয়। মুসলিম মানেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী। আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে যে কোনো আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন এবং বান্দা তা পালন করতে বাধ্য। তাই তার আনুগত্য হবে শর্তহীন। আল্লাহর আদেশ সহজ হোক আর কঠিন হোক, তা পালন করার মন-মানসিকতা থাকতে হবে। আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে কোনো মায়া-মমতা ও নিজস্ব অভিরুচি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে না। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কোরবানির উদ্দেশ্য। যেমন ইব্রাহিম (আ.)-এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। যখন তার প্রিয়তমা স্ত্রী ও সদ্যজাত সন্তানকে মরু উপত্যকায় রেখে আসার হুকুম হলো—তার মনে এরকম কোনো প্রশ্নের উদয় হয়নি যে, আমার পরিবার কী খাবে? কোথায় থাকবে? তাদের নিরাপত্তার কী হবে? বরং বিনা প্রশ্নে বিনা দ্বিধায় আল্লাহতায়ালার হুকুম বাস্তবায়ন করেছেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে আল্লাহতায়ালার আরও আজ্ঞাবহ ও অনুগত বান্দা হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘পরওয়ারদেগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো।’ (সুরা বাকারা: ১২৮)। আবার পিতার প্রতি ছেলেকে কোরবানি করার নির্দেশের সামনে পিতা ইব্রাহিম (আ.) যেমনি কোনো প্রশ্ন তোলেননি, তেমনি সন্তান ইসমাইল ও সম্পূর্ণরূপে আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দিয়েছেন। যেহেতু হুকুম আল্লাহতায়ালার, সুতরাং এখানে আপত্তি করার কোনো অধিকার কারও নেই। কেননা সবকিছুর মালিক তো তিনিই। এ জীবনের মালিকও তিনি। ইব্রাহিম (আ.) নিজেই করেছিলেন এমন উক্তি, ‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’ (সুরা আনআম: ১৬২)।
কোরবানির ঈদে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানিদাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: ৩৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিনে কোনো আদম সন্তানের কোরবানির পশুর রক্ত প্রবাহিত করার থেকে মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় কোনো আমল নেই। কেয়ামত দিবসে কোরবানির পশু শিং, খুর, পশম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তার রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয়। অতএব, তোমরা প্রফুল্লচিত্তে কোরবানি করো।’ (ইবনে মাজাহ: ৩১২৬)।
পৃথিবীতে ত্যাগী মানুষের অভাব আদিকাল থেকেই। ত্যাগের স্থান দখল করে রেখেছে স্বার্থপরতা ও পরশ্রীকাতরতা। কোরবানি হলো একটি ত্যাগের পরীক্ষা। আল্লাহর বিধান পালনে জানমালের ত্যাগ স্বীকার করার যোগ্যতা তৈরি হয়। কোরবানির ঈদ শুধু গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত না করে বরং নিজেদের মধ্যকার পশুসুলভ আচরণ তথা লোভ ও স্বার্থপরতা ত্যাগ করার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার একটি প্রস্তুতিমূলক আয়োজন।
কোরবানির মাধ্যমে সামাজিক ও পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রেরণা তৈরি হয়। একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করা এবং কোরবানির গোশত গরিব-দুঃখী, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর মধ্যে বণ্টনের মাধ্যমে তৈরি হয় সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহাবস্থান ও সামাজিক ঐক্যবদ্ধতার মানসিকতা। আর ইসলাম বিচ্ছিন্নতা প্রশ্রয় দেয় না বরং নির্দেশ দেয় ঐক্যবদ্ধতার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেও না।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)। প্রতি বছর এ মহান শিক্ষার কথাই যেন কোরবানি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
কোরবানিতে গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়। যারা বছরে একবারও গোশত খেতে পারে না, তারাও গোশত খাবার সুযোগ পায়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা যায়। কোরবানির পশুর চাহিদা মেটাতে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিকভাবে পশু পালনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোরবানির চামড়ার টাকা গরিবের মধ্যে বণ্টন করার মাধ্যমে গরিব-দুঃখী মানুষের নিত্যদিনের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে কোরবানির পশু চামড়া অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। সব মিলিয়ে কোরবানি আমাদের ধর্মীয়-জাতীয় জীবনে অন্যতম একটি প্রভাবক অনুষঙ্গ। কোরবানির মূল শিক্ষা সবার জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে— এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন