বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংবিধানের মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়ার জন্য বিকল্প খুঁজে বেড়াচ্ছে। আসলে, স্বাধীনতার কয়েক মাস পর থেকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ক্ষমতাসীন সরকারের উদ্দিষ্ট ছিল না। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে যে বাকশাল কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছিল, তাতে বেশ কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি প্রচলনের উদ্দেশ্য অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, ওগুলো বাস্তবায়নের আগেই বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে উৎখাত হয়ে যাওয়ায় এর পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মতামত প্রদানের সুযোগই সৃষ্টি হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে যে ছাত্রছাত্রীরা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তাদের মাধ্যমে গঠিত সরকার সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলতে চাইছে, ব্যাপারটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সমাজতন্ত্র ব্যতিরেকে বৈষম্য-নিরসন খুবই দুরূহ ব্যাপার। সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতন্ত্র বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বই দশকে পরিত্যক্ত হয়ে গেলেও, ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের’ নানা পরিবর্তিত মডেল বিশ্বের নানা দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করায় সফলভাবে অনুসৃত হয়ে চলেছে। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের যে মডেলগুলো বিশ্বের নানা দেশে প্রচলিত ছিল, সেগুলো কোনো দেশেই সফল হয়নি বললে অত্যুক্তি হবে না। বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে ওগুলোর প্রায় সবই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। ২০২৫ সালে সমাজতন্ত্রের যে পরিবর্তিত মডেলগুলো বিশ্বের কয়েকটি দেশে চালু রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি সমাজতন্ত্রের পুরোনো মডেলগুলোর সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিগুলো থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে দুটি মডেল নিয়ে আজ আলোচনা করতে চাই—চীন ও ভিয়েতনামের মডেল। এ দুটি মডেল গত সাড়ে চার দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম প্রমাণিত হয়েছে, তার ফলে ওগুলো থেকে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে মনে করি।
প্রথমেই সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০০৮ সালের পর শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব-একাধিপত্যের পতনের ধারা। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর গত ৮০ বছর ধরে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-আধিপত্য (হেজিমনি)। এতদ্সত্ত্বেও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে পারেনি তারা। ১৯৫০-৫৩-এর কোরিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা আজও টিকে রয়েছে। ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে ফ্রান্সকে, কিন্তু ১৯৫৫ সালে আবার মার্কিন পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দক্ষিণ ভিয়েতনামে জেঁকে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে, ২০ বছর ধরে ভিয়েতনামে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র বনাম উত্তর ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মহারক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। প্রায় ২০ লাখ মৃত্যুর বিনিময়ে ওই যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল ভিয়েতনাম, লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৫ সালে পালাতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। ওই সময় কাম্পুচিয়া ও লাওসেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলেও মার্কিনিরা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চীনের ওই রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নেয়নি (১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন চীনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে)। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মার্কিনিদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা সত্ত্বেও। আশির দশকে পোল্যান্ডে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সফল হওয়ায় পূর্ব ইউরোপের সব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সংগ্রামের মাধ্যমে ডমিনো স্টাইলে ভেঙে পড়ে সমাজতন্ত্র। সবশেষে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপ ঘোষণা করে রাশিয়া। এসব পরিবর্তনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কালোহাত প্রতিটি ক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিল।
আশি ও নব্বই দশকের এ ঐতিহাসিক প্রতিবিপ্লবের ধারার কারণে মনে করা হয়েছিল, সমাজতন্ত্র ক্রমেই বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মার্কিনিরা বিশ্বের একক সুপারপাওয়ারে পরিণত হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে সমাজতান্ত্রিক মডেলগুলোর পতন শুরু হওয়ার আগেই অথবা সমসাময়িক কালে চীন ১৯৭৮ ও ভিয়েতনাম ১৯৮৬ সালে তাদের সমাজতান্ত্রিক মডেলগুলোয় যুগোপযোগী পরিবর্তন সাধন করে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করায় চমকপ্রদ সফলতা অর্জন করতে সমর্থ হয়। সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতান্ত্রিক মডেল যে একসময় স্থবিরতায় আক্রান্ত হবে, সে বাস্তবতা উপলব্ধি করে চীনে ১৯৭৮ সালে অভূতপূর্ব বিপ্লবী-সংস্কার কার্যক্রম গৃহীত হয়, যেখানে কৃষি খাতে আবার ‘ফ্যামিলি রেসপনসিভিলিটি সিস্টেম’ চালু করে সম্পত্তির ওপর জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে আনা হয়, অন্যদিকে সারা দেশের শহর ও গ্রামগুলোতে ‘টাউনশিপ অ্যান্ড ভিলেজ এন্টারপ্রাইজ’ (টিভিই) চালুর মাধ্যমে সীমিত পরিসরে প্রাইভেট এন্টারপ্রিনিয়রশিপ ও সমবায় কার্যক্রম অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হয়। চীনে কয়েক লাখ টিভিই গড়ে উঠেছে গত ৪০ বছরে, যেগুলো ক্রমেই প্রাইভেট খাতের সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উন্নয়নের এক চমকপ্রদ মডেলে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে প্রবল ও সুদূরপ্রসারী প্রণোদনা দিয়ে বৈদেশিক পুঁজি ও বহুজাতিক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমন্ত্রণ জানায়। সারা বিশ্ব থেকে অভূতপূর্ব দ্রুততায় চীনে ছুটে আসে বহুজাতিক পুঁজিবাদী বিনিয়োগ। তারা গ্রহণ করে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের একটি চমকপ্রদ মডেল, যেখানে রাষ্ট্র সুপরিকল্পিতভাবে রপ্তানি খাতে প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের পথের সব বাধা-বিঘ্ন দূর করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। গত তিন দশক ধরে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বলা হয়, অধিকাংশ শিল্পের ক্ষেত্রে দেশটি এখন ‘বিশ্বের ফ্যাক্টরি’। অথচ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চীন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বহাল রেখে দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টিতে রুখে দাঁড়ায়। পাশাপাশি, অত্যন্ত সুচতুর পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দ্রুত উন্নতি সাধনের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এর ফলে, অর্থনীতির ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ ২০২৫ সালেও বহাল রয়ে গেছে রাষ্ট্রের মালিকানায়, বাকি ৫০ শতাংশের ওপর প্রাইভেট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কোনোরকমের বাধা খাড়া করেনি রাষ্ট্র। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এ নতুন মডেলের বাস্তবায়নে চীন রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ এতটুকুও শিথিল করেনি, অর্থনীতির ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণও পুরোপুরি অটুট রয়ে গেছে। তারা এ মডেলকে নাম দিয়েছে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ অথবা ‘চীনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্র’ (সোশ্যালিজম উইথ চায়নিজ ক্যারেক্টারিস্টিকস)। ২০০৮ সালের মধ্যেই চীন দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণে শতভাগ সফলতা অর্জন করে, এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে। আইএমএফ ঘোষণা করেছে, ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের নিক্তিতে ২০১৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের তারতম্য বিবেচনায় নিয়ে প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে যে, ২০৩১ সালের মধ্যেই নমিনাল জিডিপির নিক্তিতেও যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে চীন ‘বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতিতে’ পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে।
অন্যদিকে, ভিয়েতনাম প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতা-যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে ১৯৭৫ সালে। তিন দশকের চরম-বিধ্বংসী স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে ওই সময় ভিয়েতনাম বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। বিশ্বের জনগণের কাছে তারা হলো সবচেয়ে বেশি রক্ত-ঝরানো স্বাধীনতা-যুদ্ধে বিজয়ী দেশ। সমাজতন্ত্রী ভিয়েতনাম বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা বিশ্বের দুটি সুপারপাওয়ার ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে নিজেদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। ফ্রান্স পরাজয় বরণ করেছে ১৯৫৪ এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম যখন স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, তখন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’—সুকান্তের এ অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য দেশটির বীর জনগণের ক্ষেত্রে। যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্বাধীন ভিয়েতনামকে মার্কিনিরা অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পঙ্গু রাখারও ব্যবস্থা করেছে দুই দশক। এতদ্সত্ত্বেও তারা কখনোই কোনো দেশের কাছে মাথানত করেনি, ভিক্ষার জন্য হাত পাতেনি। এমনকি, অনুদান ও ‘সফট লোনের’ আশায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি। অথচ, কী দারুণ কষ্টকর ছিল ১৯৭৫-পরবর্তী বছরগুলোয় জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার, ১৯৮৫ সালে ছিল ২৮৫ ডলার। ২০২৫ সালে আইএমএফের প্রাক্কলন অনুযায়ী মোট জিডিপি ৪৯০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালে মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ৪,৮০৬ ডলারে পৌঁছে গেছে, যেটাকে ‘মিরাকল’ বলা হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৪ সালে পৌঁছে গেছে ১৭,৪৮৪ পিপিপি ডলারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৮.৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে মাত্র ২ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ বা রিনোভেশন নাম দিয়ে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার ৩৯ বছর পর এখন পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-চিন্তকরা ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে ‘সোশ্যালিস্ট-ওরিয়েন্টেড মার্কেট ইকোনমি’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। ‘দোই মোই’ কর্মসূচিতে ‘কালেকটিভ ফার্মিং’ নিষিদ্ধ হয়েছে, জমির ওপর জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ উভয়কে উৎসাহিত করা হয়েছে। ‘দোই মোই’ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান তিনটি ডাইমেনশন হলো—১. অত্যন্ত শক্তহাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উদারীকরণ; ২. অত্যন্ত দ্রুত অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বি-নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাসের মাধ্যমে ব্যবসা করার খরচ ও বাধাবিঘ্ন কমিয়ে ফেলা এবং ৩. রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ প্রবলভাবে জোরদার করার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন (শিক্ষা) ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রথম অগ্রাধিকারে পরিণত করা। বিশেষত, প্রাইমারি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই তার পুরো জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত করে তুলেছে এবং জনগণের বিশাল একটি অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল করে তুলেছে। একইভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ভিয়েতনাম তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈষম্য তেমন একটা বাড়তে দেয়নি। দেশটির জনগণ শতভাগ ২০২৫ সালে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় সেবা পেয়ে চলেছে। জনসংখ্যা নীতির ব্যাপারে কঠোরভাবে ‘দুই সন্তান নীতি’ অনুসরণ করে চলেছে। আয় ও সম্পদ বৈষম্যের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সযতনে বৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতা প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল কয়েকটি নগরে কেন্দ্রীভূত না করে ভিয়েতনাম গ্রামীণ জনগণের মাঝে উন্নয়নের সব ডাইমেনশনকে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবলভাবে উৎসাহিত করে চলেছে। স্যামসাং, এলজি, অলিম্পাস, পাইওনিয়ার—এসব কোম্পানির দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় হাব এখন ভিয়েতনামে। এখন প্রতি বছর বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ দাঁড়াচ্ছে ২০-২৫ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রয়ে গেছে, কিন্তু ব্যাংকঋণে উদ্যোক্তাদের অভিগম্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে সহজ ও বহুল বিস্তৃত করা হয়েছে। এ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতার পেছনের চাবিকাঠি হলো ভিয়েতনামে দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম, শ্রমশক্তি ও মানব পুঁজি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শিক্ষিত, দক্ষ ও পরিশ্রমী। তাদের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন চমকপ্রদ। বন্দর, মহাসড়ক ও সুলভ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে দ্রুত আধুনিকায়নে সফল একটি দেশ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম এখন বাংলাদেশকে হটিয়ে মাঝেমধ্যে গণচীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানটি দখল করে নিচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে এখন সিঙ্গাপুরের পর ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। চাল রপ্তানিতে থাইল্যান্ডকে হটিয়ে ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ব্রাজিলের পর কফি রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সাড়ে নয় কোটি জনসংখ্যার দেশের মোট রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ২০২৪ সালে রপ্তানি আয় ছিল ৪০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (স্যামসাং একাই ভিয়েতনামের রপ্তানি আয়ের এক-চতুর্থাংশ নিয়ে আসছে)। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনে উৎপাদনরত অনেক শিল্প-কারখানা এখন ভিয়েতনামে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভিয়েতনাম থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টি। উৎপাদনের সবক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের ক্ষমতায়ন এবং গ্রাম-সমবায়ের ক্ষেত্রেও ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে। সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতন্ত্রকে যে যুগোপযোগী সংস্কার করতেই হবে, এটা বুঝে নিয়েই দেশটি ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে বুঁদ না হয়েও যে ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের’ মাধ্যমে অর্থনৈতিক ‘মিরাকল’ ঘটানো সম্ভব, সেটারই অকাট্য প্রমাণ ভিয়েতনাম। চীন বা ভিয়েতনামের একদলীয় শাসন আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও এ দুটো সমাজতান্ত্রিক মডেল থেকে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। বিশেষত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, আয়বৈষম্য নিরসন ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে কীভাবে এ দুটি দেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে; তা গভীরভাবে বিবেচনা করা সমীচীন মনে করি।
ড. মইনুল ইসলাম
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন