

কখনো সরাসরি, কখনো কৌশলে টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এবার সরাসরি টিকিটের দাম না বাড়িয়ে ‘পন্টেজ চার্জ’ বা মাশুল আরোপের মাধ্যমে ঢাকা-কক্সবাজারসহ ৬টি রুটে ট্রেনের ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ট্রেনে যাতায়াতে যাত্রীদের এখন থেকে গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া।
শনিবার (২০ ডিসেম্বর) থেকে নতুন এ ভাড়া কার্যকর করা হয়েছে।
আসন ও রুটভেদে সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২২৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে ভাড়া। তবে বিষয়টি নিয়ে ভোক্তা সংগঠনগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, চট্টগ্রামের যেসব রুটে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে সেগুলো সবই লাভজনক। সেক্ষেত্রে এখানে ভাড়া বাড়ানোর কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এবার যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, তা সব রুটে নয়, নির্দিষ্ট কিছু রুটে বেড়েছে। তবে তা খুব বেশি নয়। মূলত সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পন্টেজ চার্জ আরোপের মাধ্যমে এ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে পুরোনো যেসব সেতু আছে (১০০ মিটারের বেশি), সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের জন্য।
রেল সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম-সিলেট, চট্টগ্রাম-জামালপুর ও ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ এ ছয় রুটের ১১টি সেতুতে পন্টেজ চার্জ আরোপ করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া ২০১২ সালে ছিল ৫৮৫ টাকা। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৭২৫ টাকা। ২০২৪ সালে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহারের পর ভাড়া দাঁড়ায় ৮৫৫ টাকা। নতুন পন্টেজ চার্জ যুক্ত হওয়ার পর এখন যাত্রীদের দিতে হচ্ছে ৯৪৩ টাকা।
এ ছাড়া, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলাচলরত কক্সবাজার ও পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া এক হাজার ৩২২ থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪৪৯ টাকা। এসি বার্থের ভাড়া ২ হাজার ৪৩০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৫৬ টাকায়। এ রুটে সর্বোচ্চ ২২৬ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে।
ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে ভোক্তা সংগঠনগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, চট্টগ্রামের যেসব রুটে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে সেগুলো সবই লাভজনক। সেক্ষেত্রে এখানে ভাড়া বাড়ানোর কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই। যেখানে লোকসান, সেখানে ভাড়া বাড়ানো যেত। সেবা না বাড়িয়ে মূল্য বাড়ানোর উদ্যোগ মূলত মানুষকে রেল বিমুখিতা করার জন্যই। মানুষ এখন রেলের দিকেই ঝুঁকেছে। অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে মানুষজন যেন এদিকে না যায়, এ কারণে অসাধু রেল কর্মকর্তারা এমন উদ্যোগ নিয়েছে।
ভাড়া কোন রুটে কত বাড়ল : ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আগে ৩৪৬ কিলোমিটার দূরত্ব ধরে ভাড়া দিতে হতো। এখন পন্টেজ চার্জ নির্ধারণের পর এ দূরত্ব হয়েছে ৩৮১ কিলোমিটার। ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এ রুটে মেইলের ভাড়া ১৩৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। ভাড়া বেড়েছে ১৫ টাকা। এ ছাড়া কমিউটার ও শোভন চেয়ারে ভাড়া ১৭০ ও ৪০৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৯০ ও ৪৫০ টাকায়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বেশি চাহিদা রয়েছে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটের। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্নিগ্ধা টিকিটের ভাড়া ৭৭৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৫৭ টাকা। ভাড়া বেড়েছে ৮০ টাকা। এসি সিটের ভাড়া ৯৩২ থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩০ টাকা। আবার এসি বার্থের (শুয়ে যাওয়ার আসন) ভাড়া এখন থেকে হবে ১ হাজার ৫৯১ টাকা। বর্তমানে এসব আসনের ভাড়া ১ হাজার ৪৪৮ টাকা। এ রুটে বিরতিহীন ট্রেনে (যেমন সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও সোনার বাংলা এক্সপ্রেস) স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া ৮৫৫ থেকে ৮৮ টাকা বেড়ে হয়েছে ৯৪৩ টাকা। প্রথম বার্থ ও এসি সিটের প্রতি আসনের ভাড়া এখন যথাক্রমে ১ হাজার ১৩৩ ও ১ হাজার ৭৪৬ টাকা। আগে ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ২৫ ও ১ হাজার ৫৯০ টাকা।
ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে চলাচলরত কক্সবাজার ও পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের বর্তমানে স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া ১ হাজার ৩২২ টাকা। এখন থেকে দিতে হবে ১ হাজার ৪৪৯ টাকা। ভাড়া বেড়েছে ১২৭ টাকা। এসি সিটের ভাড়া ১ হাজার ৫৯০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৭৪০ টাকা। আর এসি বার্থের ভাড়া এখন ২ হাজার ৪৩০ টাকা, নতুন ভাড়া অনুযায়ী তা হয়েছে ২ হাজার ৬৫৬ টাকা। আগের তুলনায় ভাড়া বেড়েছে ২২৬ টাকা।
ঢাকা-সিলেট রুটে মেইল ট্রেনের ভাড়া ১২৫ থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা হয়েছে। কমিউটার ট্রেনের ভাড়া ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা করা হয়েছে। শোভন চেয়ারের ভাড়া ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ৪১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া বর্তমানে ৭১৯ টাকা হলেও নতুন ভাড়া হবে ৭৮৮ টাকা। এসি সিটের ভাড়া ৮৬৩ টাকার জায়গায় এখন হবে ৯৪৩ টাকা। এসি বার্থের ভাড়া ১২৭ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৪৬৫ হয়েছে।
চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া ৮৫৭ টাকার জায়গায় দিতে হবে ৯০৯ টাকা। শোভন চেয়ারের ভাড়া বেড়েছে ২৫ টাকা। প্রথম বার্থের ভাড়া ১ হাজার ৮০ থেকে ১ হাজার ১৩৭ টাকা করা হয়েছে। এসি সিটের ভাড়া ১ হাজার ৩০ থেকে ১ হাজার ৮৭ টাকা হয়েছে। এসি বার্থের ভাড়া বেড়েছে ৮৭ টাকা। আগে ছিল ১ হাজার ৫৯১ টাকা, এখন দিতে হবে ১ হাজার ৬৭৮ টাকা।
চট্টগ্রাম-জামালপুর রুটে মেইল ট্রেনের ভাড়া ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকা হয়েছে। শোভন চেয়ারের ভাড়া ৫২৫ থেকে ৫৪৫ টাকা করা হয়।
স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৩৪ টাকা। আগে ছিল ১ হাজার ৭ টাকা, এখন হবে ১ হাজার ৪১ টাকা। এসি সিটের ভাড়া বেড়েছে ৪৬ টাকা। ১ হাজার ২০৮ টাকার টিকিট কিনতে হবে ১ হাজার ২৫৪ টাকায়। এসি বার্থের ভাড়া ১ হাজার ৮৫৬ থেকে হয়েছে ১ হাজার ৯২৫ টাকা।
ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটে মেইল ট্রেনের ভাড়া বাড়েনি। তবে কমিউটার ট্রেনের ভাড়া বেড়েছে ৫ টাকা। ১০৫ টাকার ভাড়া এখন ১১০ টাকা। শোভন চেয়ারের ভাড়া ২৫০ থেকে ২৫৫ টাকা, স্নিগ্ধা আসনের ভাড়া ৪৭৮ থেকে ৪৮৯ টাকা, এসি সিটের ভাড়া ৫৭৫ থেকে ৫৮৭ টাকা এবং এসি বার্থের ভাড়া ৯০৭ থেকে ৯২৪ টাকা করা হয়।
বারবার ভাড়া বাড়াচ্ছে রেল : ২০১২ সালে একলাফে ভাড়া বাড়ানো হয় ৫০ শতাংশ। এর ২০ বছর আগে ১৯৯২ সালে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। ২০১২ সালে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়ার ভিত্তি ছিল ৩৬ পয়সা করে। আসন ভেদে ভাড়ার হার পরিবর্তন হতো। তবে মূল ভিত্তি ছিল ৩৬ পয়সা। এর চার বছর পর ২০১৬ সালে কিলোমিটারে ভাড়া ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। তখন প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ পয়সা।
এরপর ২০২২ সালে নন-এসি প্রথম শ্রেণির টিকিটের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করে রেলওয়ে। এসি টিকিটের ওপর আগে থেকে ভ্যাট আরোপ করা ছিল। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চাপে ওই বছরের ১৮ জুলাই থেকে ভ্যাট কার্যকর করে রেলওয়ে।
এভাবে ভাড়া বৃদ্ধির পরেও থেমে থাকেনি রেলওয়ে। গত বছর দুই কৌশলে ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। ২০২৪ সালের মার্চে অতিরিক্ত সংযোজন করা বগির এসি ও নন-এসি আসনের জন্য নির্ধারিত মূল ভাড়ার সঙ্গে যথাক্রমে ৩০ ও ২০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া যোগ করা হয়। অর্থাৎ ৫০০ টাকার টিকিট হয়ে যায় ৬৫০ টাকা।
বিশেষ করে টানা ছুটির সময় যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়। তখন যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনা করে মূল বগির সঙ্গে অতিরিক্ত বগি যুক্ত করে রেলওয়ে। তখন এসব বগির টিকিট নিতে গেলে যাত্রীদের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে টাকা বাড়তি দিতে হয়। একই যাত্রায়, একই ট্রেনে একই গন্তব্যের জন্য দুই ধরনের ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের।
যাত্রীদের ওপর বড় চাপ হয়ে আসে রেয়াতি (ছাড়) সুবিধা প্রত্যাহারের পর। একসময় যাত্রীদের ট্রেনে যাতায়াতের ব্যাপারে আকর্ষণ করার জন্য লম্বা দূরত্বের ভাড়ার ক্ষেত্রে রেয়াতি সুবিধা দিত রেল। যেমন ১০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য যাত্রীরা ২০ শতাংশ ভাড়া রেয়াত পেতেন যাত্রীরা। ২৫১ থেকে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত রেয়াতি সুবিধা হচ্ছে ২৫ শতাংশ। এর ঊর্ধ্বে ৩০ শতাংশ। কিন্তু গত বছরের মে মাসে এ রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়।
মন্তব্য করুন