

বৃত্তি উৎসবের নামে সাতক্ষীরায় শিক্ষাবাণিজ্য ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। শহরের নামিদামি কোচিং সেন্টারগুলো ‘বৃত্তি পরীক্ষা’র আড়ালে গড়ে তুলেছে অর্থ উপার্জনের এক রমরমা ব্যবসা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ নয়, বরং অভিভাবকদের প্রতিযোগিতার মনোভাবকে পুঁজি করেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে এ কোচিং বাণিজ্য।
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকালে সাতক্ষীরা শহরের নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ‘বেসিক কোচিং সেন্টার’ আয়োজিত ‘বেসিক বৃত্তি উৎসব-২০২৫’ পরীক্ষায় দেখা যায় চরম অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার চিত্র।
সকাল থেকেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকে ঠাসা। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ, প্রায় তিন হাজার শিশুকে একসঙ্গে গাদাগাদি করে বসানো হয়। পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল না থাকায় অনেকেই মেঝেতে বসে পরীক্ষা দিয়েছে। গরম ও ভিড়ে ছোট ছোট শিশুরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না।
পরীক্ষা শেষে বিদ্যালয়ের বাইরে অভিভাবকদের মধ্যে সৃষ্টি হয় হাহাকার। কেউ সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কেউ আবার গেটের বাইরে ঠাসা ভিড়ে বাচ্চার নাম ধরে ডাকছিলেন। এক মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার মেয়েটাকে পাচ্ছিলাম না প্রায় আধা ঘণ্টা। ভিড়ের মধ্যে কান্নার শব্দ শুনে খুঁজে পাই। যদি স্কুলে এমন অব্যবস্থা হয়, তাহলে আমরা কোথায় নিরাপদ?’
অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়েছে, যা প্রায় তিন লাখ টাকা। অথচ সেই অর্থের কোনো জবাবদিহিতা নেই। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই এমন বাণিজ্যিক পরীক্ষার আয়োজন করেছে আয়োজক প্রতিষ্ঠান।
অভিভাবক গোলাম সাকলাইন বলেন, এটা শিক্ষা নয়, সরাসরি বাণিজ্য। শত শত শিশু একত্রে পরীক্ষা দিচ্ছে, কোনো সুরক্ষা বা তদারকি নেই। শুধুই টাকার খেলা।
আরেকজন অভিভাবক নাদিম সাকের বলেন, আমরা নিজেরাই সন্তানদের বিপদে ঠেলে দিচ্ছি। সমাজে ‘আমার ছেলে-মেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে’ এই অহংকারের জন্য আমরা তাদের অযৌক্তিক প্রতিযোগিতায় পাঠাচ্ছি। কোচিংগুলো সেই আবেগকেই পুঁজি করে টাকা কামাচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান ভুট্টো বলেন, বেসিক কোচিং সেন্টার নবারুণ স্কুলে তিন হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে বসিয়েছে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০০ টাকা করে নিয়েছে, প্রায় তিন লাখ টাকা। খরচ হয়েছে এক লাখের বেশি নয়, বাকিটা তাদের বাণিজ্য। এই কারণে সাধারণ অভিভাবক ও শিশুরা চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন।
শিক্ষাবিদ ও সচেতন নাগরিকরা বলছেন, শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করার এই প্রবণতা উদ্বেগজনক। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও সৃজনশীলতা নষ্ট হচ্ছে। মুখস্থবিদ্যা ও প্রতিযোগিতার এই সংস্কৃতি শিশুদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। তারা বলেন, বৃত্তির নামে এই ধরনের আয়োজন বন্ধ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানসিক অবসাদে ভুগবে।
তাদের মতে, দেশের শিক্ষানীতিতে কোচিং সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি দুর্বল। শিক্ষা অফিস ও প্রশাসনের তদারকির অভাবে কোচিং বাণিজ্য দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরার সচেতন মহল প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এসব কোচিং সেন্টারের বাণিজ্যিক বৃত্তি পরীক্ষা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার আয়োজন বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। তাদের দাবি, শিক্ষাকে ব্যবসায় নয়-মানবিকতা, সৃজনশীলতা ও নিরাপত্তার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে এখনই। শিশুদের কান্না যেন আর কোনো পরীক্ষার প্রাঙ্গণে না শোনা যায়।
তারা আরও বলেন, সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক শিক্ষা-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও শহরের কোচিং সেন্টারগুলো সেই ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বৃত্তির নামে অর্থ উপার্জনের খেলায় মেতে উঠেছে।
তবে বেসিক কোচিং সেন্টারের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অস্বীকার করে কালবেলাকে বলেন, নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়টি আমরা আজকের জন্য দুই হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছি।
অন্যদিকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মালেক কালবেলাকে বলেন, আমাদের স্কুলের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ দেড় হাজার শিক্ষার্থী। আয়োজকরা সেই সীমার মধ্যে পরীক্ষা নেবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু তারা বেশি শিক্ষার্থী নিয়েছে কিনা, তা জানি না। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।
ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আমরা কেবল বিদ্যুৎ খরচ বাবদ দুই হাজার টাকা নিয়েছি।
মন্তব্য করুন