প্রায় ১৭ বছর পর গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা গেল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে। এর আগে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তিনি তার দলের নেতৃত্বের শীর্ষে যেমন ছিলেন না, তেমনি অভিজ্ঞতার ঝুলিটাও এতটা সমৃদ্ধ ছিল না।
আজকের মতো অনির্ধারিত প্রশ্নোত্তর, ১৭ বছরের লম্বা বিরতি, জমে থাকা হাজারো প্রশ্ন, বিব্রতকর জিজ্ঞাসা, ব্যক্তিগত পারিবারিক তথ্যানুন্ধান সুদীর্ঘ কথোপকথন এসব কিছুর মুখোমুখি হয়ে কতটা সম্প্রতিভ থাকতে পারবেন তিনি, সে জিজ্ঞাসা ছিল অনেকেরই। শুরুতে আড়ষ্টতা কিছুটা ছিল না তেমন বোধ হয় বলা যাবে না। তবে সময় যত গড়িয়েছে ততটাই স্বচ্ছন্দে তিনি সব প্রশ্ন সামলেছেন।
পুরোটা দেখে সেটাই মনে হয়েছে উত্তর দেওয়ার সময় তার মাঝে কোন অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি অন্তর দিয়ে সেটা বিশ্বাস করেন সেটাই বলেছেন নির্দ্বিধায়, প্রচলিত রাজনীতিতে অস্পষ্টতা রেখে, পরোক্ষ বা গা বাঁচানো উত্তর দেওয়াটাই যখন প্রায় প্রথাসিদ্ধ বলেই সবাই জানে। কোন প্রশ্ন পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছেন এমনও নয়, কথা বলেছেন বলিষ্ঠ আত্ম বিশ্বাসী অবস্থান থেকে, এটা তার অনুসারী, দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দীপ্ত করবে সন্দেহ নেই।
কথা বলার সময় তিনি যতটা না দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অবস্থান থেকে কথা বলেছেন তার চাইতে অনেক বেশি সচেষ্ট ছিলেন তার কথোপকথনে জাতীয় ঐক্যের সুরটা যেন আরও বেশি বলিষ্ঠ শোনা যায়। তার বক্তব্যের এই ধারা দেশের রাজনৈতিক সুস্থতার জন্য অনেক প্রয়োজনীয়। প্রতিপক্ষকে অনাবশ্যক আক্রমণের সুযোগ যেমন নেননি ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এক সাধারণ মানুষের মতো ভদ্রোচিত অস্বস্তিতে ছিলেন, যেন তার কোন কথাতেই আত্মম্ভরিতা বা অহংকার প্রকাশিত না হয়, শ্রোতা দর্শকের কাছে তার এই অভিব্যক্তি নিশ্চয়ই নজর এড়াবে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর সন্তান, এমন সৌভাগ্যের সাথে জনগণকে তাচ্ছিল্য করার প্রচলিত সংস্কৃতির সাথে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া দর্শক শ্রোতাকে আবারো সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি সেটাও এই সাক্ষাৎকারে অন্যতম প্রাপ্তি।
তার দেশে ফেরা নিয়ে এতোদিন যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে দলের নেতা-কর্মীরা প্রায়ই অস্পষ্টতার আশ্রয় নিতেন আজকের সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই সেটা স্পষ্ট করেছেন অনেকটাই। বলেছেন, কিছু সঙ্গত কারণে এখনো দেশে ফেরা হয়ে উঠেনি। এখন ফেরার সময় চলে এসেছে। দ্রুতই দেশে ফিরবো ইনশাআল্লাহ। সেই সঙ্গত কারণের মধ্যে নিরাপত্তা ছাড়াও হয়তো এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেটা আমাদের মতো সাধারণের বোধের বিষয় নয়। তবে তার বা জিয়া পরিবারের নিরাপত্তার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর বাংলাদেশের খোল নলচে বদলে যাওয়ার মতো ঝুঁকি যে আছে সেটা সম্ভবত সাধারণের অজানা নয়। স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকবো? নির্বাচনের সময় জনগণের সাথে, জনগণের মাঝেই থাকবো ইনশাআল্লাহ।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাস্টার মাইন্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, সবিনয়ে যথার্থই বলেছেন, এখানে মাস্টার মাইন্ড কোন ব্যক্তি বা দল নয়। দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণই গণঅভ্যুত্থানের মাস্টার মাইন্ড। এই উপলব্ধি সার্বজনীন হলে আমরা জাতীয় ঐক্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছতে পারতাম।
পতিত স্বৈরাচারের বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে সাবলীলভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন, ‘নির্যাতনকারী প্রত্যেকের বিচার হতে হবে। এটা প্রতিশোধের বিষয় নয়। এটা ন্যায়ের কথা,আইনের কথা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্যায় করে থাকলে দেশের আইন অনুযায়ী তারও বিচার হতে হবে।’ এই স্পষ্ট কথাগুলো বলে তিনি আওয়ামী লীগকে নিয়ে তার দলের বিরুদ্ধে তথাকথিত প্রশ্রয় বা নমনীয়তা নিয়ে যে অভিযোগ বা অনুযোগ রয়েছে সেটার নিষ্পত্তি তিনি কোন রাখ ঢাক ছাড়াই করে দিয়েছেন।
আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে তিনি প্রচলিত গদবাঁধা কথার বাইরে যেতে পেরেছেন সেটাও এই পরিবর্তিত বাংলাদেশের জন্য নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, ‘তাকেই মনোনয়ন দিতে চাই, যিনি তার এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, তরুণ, নারী, মুরুব্বী, ছাত্র-ছাত্রী সবার সাথে যোগাযোগ আছে। জন সমর্থনকে যিনি তার সাথে রাখতে পারেন। আমরা দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছি না বরং এমন মানুষ খুঁজে বের করতে চাই যার প্রতি এলাকার মানুষের সমর্থন রয়েছে, শুধুমাত্র দলের সমর্থন নয়-এমন মানুষ।’ তার কথায় প্রচলিত রাজনীতির চলমান ধারার বাইরের কথাগুলো তার অন্তরের কথা হলে আগামীতে দলের প্রার্থী নির্বাচনে আমরা ‘প্রকৃত’ যোগ্য প্রার্থীর সমাগম দেখতে পাব এমন প্রত্যাশা রাখতে চাই।
পারিবারিক ধারাবাহিকতায় উত্তরাধিকার সূত্রে তার রাজনৈতিক উত্তরণ কিনা? এমন স্পর্শকাতর প্রশ্নেও অভিব্যক্তির ভাবান্তর না ঘটিয়ে স্বাচ্ছন্দেই বলেছেন, বাংলাদেশের প্রচলিত রজনৈতিক ধারায় মামলা, নির্যাতন, পারিবারিক বঞ্চনা এগুলো যেমন স্বাভাবিক পুরস্কার- সেগুলোর প্রতিটি পর্বই তার জীবনে এসেছে নির্মমভাবে। জেল যাত্রার আগে সুস্থ মা জেল থেকে ফিরেছেন মরণব্যধি সাথে নিয়ে। বিনা চিকিৎসায় বিদেশে মৃত্যুবরণ করেছে একমাত্র ভাই। স্ত্রীকে বাংলাদেশে সম্মানজনক চিকিৎসা পেশায় সুযোগ বঞ্চিত হতে হয়েছে, একমাত্র কন্যা বঞ্চিত হয়েছে কৈশর ও তারুণ্য থেকে। নিজে বঞ্চিত হয়েছেন নেতাকর্মী আর মায়ের সান্নিধ্য থেকে- একদিন দুদিন নয়, পুরো দেড় যুগ। দূর প্রবাস থেকে চরম অসহায়ত্বে দর্শক হয়ে থেকেছেন যখন আশৈশব স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মায়ের অসম্মানজনক উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে শুনেছেন কেমন চরম আক্রোশে সেই বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক অভিযাত্রায় তিনি যে জবর দখল করেননি সেটার ইতিহাসও সবার জানা। শুরু করেছেন তৃণমূলের কর্মী হিসাবে, তারপর ওয়ান ইলেভেনের যন্ত্রণা সয়েছেন যখন দলের যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।
বিবিসি’র সাক্ষাৎকারে সম্মানের সঙ্গে মা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকারের অবিশিষ্টাংশ শুনতে পেলে হয়তো শেষের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ থাকবে। তবে প্রচলিত রাজনৈতিক কদর্যতা, চরিত্রহনন আর অশ্লীল আক্রমনের বাইরে একটা শোভন সাক্ষাৎকারের স্মৃতি শ্রোতা দর্শক অনেক দিনই মনে রাখবেন।
শেষ কথা, একজন জাতীয় নেতার কাছে জনগণ যে আন্তরিকতা খুঁজতে চান তারেক রহমান সে প্রত্যাশার কাছাকাছি নিজেকে নেয়ার চেষ্টা করেছেন আন্তরিক। আর বিব্রতকর বা স্পর্শকাতর বলে এতদিন যে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা অস্বস্তি বোধ করতাম তিনি সেগুলো এত পরিস্কার আর প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, প্রচলিত রাজনীতিতে আজ যারা হেভিওয়েট তারা জনগণের মনের গভীরে স্থান নিতে চাইলে তাদের নিজেদের বদলাতেই হবে।
লেখক : অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল
মন্তব্য করুন