ওমরাহ পালন প্রতিটি মুসলিমেরই হৃদয়ের লালিত স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্নযাত্রায় ভিসা আবেদন, হোটেল বুকিং, ও পরিবহন ব্যবস্থা; সব মিলিয়ে প্রক্রিয়াটি অনেক সময় জটিল ও বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে।
তাই কেউ ভরসা রাখখেন এজেন্টদের ওপর, কেউ আবার পর্যটন ভিসায় গিয়ে ওমরাহ সম্পন্ন করার চেষ্টা করেন। তবে এবার সেই প্রক্রিয়ায় এসেছে বড় পরিবর্তন।
শুক্রবার (৩ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে খালিজ টাইমস। সংযুক্ত আরব আমিরাতের উমরাহ অপারেটরদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরব উমরাহ যাত্রা আরও স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল করতে নতুন কিছু নিয়ম চালু করেছে।
এখন ভিসা আবেদন থেকে শুরু করে পরিবহন, হোটেল; সবকিছুই সরকারি অনুমোদিত অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। ফলে প্রক্রিয়াটি যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি বেড়েছে শৃঙ্খলা ও নজরদারিও।
নিচে দেওয়া হলো যাত্রার আগে প্রতিটি হাজির জন্য জানা জরুরি ১০টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন—
১. ভিসা আবেদনের সময়ই হোটেল বুকিং বাধ্যতামূলক
এখন আর ভিসা পাওয়ার পর হোটেল বুক করা যাবে না। বরং ওমরাহ ভিসার আবেদন করার সময়ই মাসার সিস্টেম বা নুসুক অ্যাপের মাধ্যমে অনুমোদিত হোটেল বুক করতে হবে। কেউ আত্মীয়ের বাসায় থাকলে তা ভিসা আবেদনের সময় উল্লেখ করতে হবে।
ওমরাহ অপারেটর কায়সার মাহমুদ বলেন, ‘হোটেল ও পরিবহন এখন সৌদির মাসার সিস্টেমে সংযুক্ত। এমনকি ট্যাক্সিও ওই পোর্টালের মাধ্যমে বুক করতে হবে, যাতে কেবল অনুমোদিত সেবাই ব্যবহার হয়।’
২. আত্মীয়ের বাসায় থাকলে দিতে হবে সৌদি আইডি নম্বর
ওমরায় গিয়ে যারা পরিবার বা আত্মীয়ের বাসায় থাকার পরিকল্পনা করছেন, তাদের সেই হোস্টের ইউনিফায়েড সৌদি আইডি নম্বর দিতে হবে। এই আইডিটি সরাসরি ভিসার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যাত্রা পরিবর্তন বা সময় পিছিয়ে দিলে একই আইডিতে তা আপডেট করতে হবে।
৩. পর্যটন ভিসায় ওমরাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
এখন থেকে পর্যটন ভিসায় কেউ ওমরাহ পালন করতে পারবেন না। অপারেটররা সতর্ক করেছেন, কেউ চেষ্টা করলে তাকে থামিয়ে দেওয়া বা এমনকি মদিনার রিয়াজুল জান্নাহয় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হতে পারে।
ওমরাহ গাইড শিহাব বলেন, ‘পর্যটন ভিসায় গেলে ঝুঁকি আছে। যেকোনো সময় আটকানো হতে পারে, এমনকি মদিনায় রিয়াজুল জান্নায়ও প্রবেশের অনুমতি মিলবে না।’
৪. আলাদা ওমরাহ ভিসা বাধ্যতামূলক
সব হাজিকেই এখন নুসুক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আলাদা ওমরাহ ভিসা নিতে হবে। এটি ই-ভিসা হিসেবে বা অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্টের প্যাকেজের মাধ্যমেও করা যাবে।‘সৌদি সিস্টেম এখন একেবারেই স্পষ্ট, শুধু ওমরাহ ভিসাই বৈধ,’ বলেন কায়সার মাহমুদ।
৫. সফরসূচি বদলানো যাবে না
ভিসা আবেদন করার সময় সফরসূচি (ইটিনারারি) আপলোড করতে হবে, যা পরবর্তীতে পরিবর্তন বা স্থগিত করা যাবে না। অনুমোদিত সময়ের বেশি থাকলে জরিমানা গুনতে হবে।
কায়সার মাহমুদের ভাষায়, ‘ফেরার তারিখ পিছিয়ে দিলে বা যাত্রা বাড়ালে প্রতি হাজির জন্য কমপক্ষে ৭৫০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ৭৩৪ দিরহাম) জরিমানা দিতে হয়, এমনকি এজেন্টের লাইসেন্সও স্থগিত হতে পারে।’
৬. কিছু দেশের নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসা
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও শেনগেন অঞ্চলের ভিসাধারী বা সেসব দেশে বসবাসকারী মুসলমানেরা অন-অ্যারাইভাল ভিসা পেতে পারেন। তবে শর্ত হলো, তারা পূর্বে ওই দেশগুলো অন্তত একবার ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের ভিসার মেয়াদ কমপক্ষে এক বছর হতে হবে।
৭. বিমানবন্দরে হোটেল ও যাত্রাবুকিং যাচাই
সৌদিতে পৌঁছানোর পর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নুসুক বা মাসার প্ল্যাটফর্মে থাকা হোটেল ও পরিবহন বুকিং যাচাই করবে। কোনো তথ্য অনুপস্থিত থাকলে যাত্রা থামিয়ে দেওয়া বা জরিমানা করা হতে পারে।
৮. কেবল অনুমোদিত ট্যাক্সি ও পরিবহন ব্যবহার
সব হাজিকেই নুসুক অ্যাপের মাধ্যমে অনুমোদিত ট্যাক্সি, বাস বা ট্রেন ব্যবহার করতে হবে। এলোমেলোভাবে কোনো গাড়ি নেওয়া যাবে না। শিহাব বলেন, ‘এখন থেকে অনুমোদিত যানবাহন ছাড়া কেউ বিমানবন্দর থেকে মক্কা বা মদিনায় যেতে পারবেন না।’
৯. ট্রেন সেবা ও সময়সীমা
হারামাইন এক্সপ্রেস ট্রেন ওমরাহ যাত্রীদের জনপ্রিয় পরিবহন, তবে এটি রাত ৯টার পর আর চালু থাকে না। যারা দেরিতে পৌঁছান, তাদের আগে থেকেই বিকল্প অনুমোদিত যানবাহন বুক করতে হবে।
১০. নিয়ম ভাঙলে কড়াকড়ি জরিমানা
নিয়ম ভাঙলে হাজি ও এজেন্ট—দুজনেরই জরিমানা হতে পারে। অনুমোদনবিহীন ট্যাক্সি ব্যবহার, নির্ধারিত সময়ের বেশি অবস্থান বা বুকিং না করা; সব ক্ষেত্রেই জরিমানার পরিমাণ শুরু হচ্ছে ৭৫০ দিরহাম থেকে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, নতুন এই নিয়মগুলো সৌদি সরকারের উদ্যোগে উমরাহ প্রক্রিয়াকে আরও নিরাপদ, স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল করতে তৈরি করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে ভিসা, যাত্রা ও আবাসন—সবকিছুই সরকারি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আওতায় থাকবে। হাজিদের জন্য এটি যেমন স্বস্তির, তেমনি নিয়ম না মানলে ঝুঁকিও কিন্তু কম নয়।
মন্তব্য করুন