যেভাবে শেষ হতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধ
ইউক্রেনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ এবং পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে সার্বিকভাবে সাহায্য করলেও এখনো রাশিয়াকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করা যায়নি। বরং ইউক্রেনের আরও অনেক এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে। রাশিয়ার এ অভিযানের দুই বছর পূর্ণ হবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি। এর ঠিক কয়েকদিন আগে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্কের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত আভদিভকার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে মস্কো কি ধীরে ধীরে তার লক্ষের দিকে এগুচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ যুদ্ধ সহজে শেষ হচ্ছে না। দীর্ঘ যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে এটি। তবে যে কোনো যুদ্ধের মতো এটিও এক দিন শেষ হবে। তাদের মতে চার উপায়ে এ যুদ্ধ শেষ হতে পারে।
গ্রন্থনা : ওয়াহেদুজ্জামান সরকার
দীর্ঘ যুদ্ধে পরিণত
রাশিয়ার কাছে সর্বশেষ ইউক্রেনের আভদিভকা শহরের পতনের পর এ যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে যে, ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহের গতি ধীর হয়ে যাওয়ায় ময়দানে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে কিয়েভ, যার কারণে আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে রাশিয়া। এ অবস্থায় ইউক্রেনকে ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পশ্চিমা দেশগুলোও হয়তো ইউক্রেনকে অস্ত্র-গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করবে। হয়তো এমনটা চলবে বেশ কয়েক বছর ধরে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সহযোগিতার কারণে ইউক্রেন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
এ অবস্থায় হয়তো রুশ বাহিনী তাদের নেতৃত্বের অদক্ষতা, যুদ্ধের সরঞ্জাম আনা-নেওয়ার সমস্যা, নিম্ন মনোবল—এরকম নানা কারণে কিছুটা দমে যেতে পারে। এমনও হতে পারে যে ইউক্রেনিয়ানদের কড়া প্রতিরোধের কারণে রুশদের পক্ষে কিয়েভের মতো শহরগুলো দখল করতে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। এর ফলে যেটা হতে পারে তা হলো—দীর্ঘ সময় ধরে শহরগুলো ঘেরাও হয়ে থাকা। ১৯৯০-এর দশকে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রজনি শহর দখলের জন্য রাশিয়ার দীর্ঘ ও রক্তাক্ত যুদ্ধে শহরটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ইউক্রেনেও হয়তো তেমন কিছু হতে পারে।
তা ছাড়া রাশিয়ার বাহিনী যদি ইউক্রেনের শহরগুলোতে কিছু উপস্থিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়ও, তাহলেও তাদের হয়তো এসব শহরের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হবে। হয়তো এমনও হতে পারে যে, ইউক্রেনের মতো একটি বড় দেশকে কবজায় রাখার মতো যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য রাশিয়া পাঠাতে পারল না। তখন ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী কার্যত একটি বিদ্রোহী বাহিনীতে পরিণত হবে—তাদের মনোবল থাকবে চাঙ্গা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীও তাদের সাহায্য করবে। এভাবে চলতে পারে কয়েক বছর। তারপর এক সময় মস্কোতে কোনো নতুন নেতৃত্ব আসবে এবং শেষ পর্যন্ত রুশ সৈন্যরা ইউক্রেন ত্যাগ করবে—ঠিক যেমনটা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছিল।
ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ
এমনটাও হতে পারে যে, এ যুদ্ধ ইউক্রেনের সীমান্ত পার হয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো রাশিয়ার সাবেক সোভিয়েত সাম্রাজ্যের আরও কিছু অংশ পুনর্দখল করার চেষ্টা করতে পারেন। তিনি হয়তো মলদোভা এবং জর্জিয়ায় রুশ সৈন্য পাঠাতে পারেন, যারা ন্যাটোর অংশ নয়। অথবা নিতান্তই ভুল হিসাব-নিকাশের কারণেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো ভাবতে পারেন যে, পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করছে, এটা এক ধরনের আগ্রাসন এবং এর পাল্টা জবাব দিতে হবে। ফলে তিনি হয়তো লিথুয়ানিয়ার মতো বাল্টিক দেশগুলোতে যারা ন্যাটো জোটের সদস্য, সেসব দেশে সৈন্য পাঠানোর হুমকি দিতে পারেন। এর আরও একটা লক্ষ্য হতে পারে, রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ ছিটমহলের সঙ্গে একটা স্থল করিডোর প্রতিষ্ঠা করা। তবে এর পরিণতি হতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং তার ফলে ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। ন্যাটো সামরিক জোটের সনদের ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এই জোটের সদস্য যে কোনো একটি দেশের ওপর আক্রমণের মানে হচ্ছে সবার ওপর আক্রমণ। কিন্তু পুতিন হয়তো এ ঝুঁকিও নিয়ে ফেলতে পারেন—যদি তার মনে হয় যে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এটাই তার একমাত্র উপায়। যদি এমন হয় যে, ইউক্রেনে তিনি পরাজয়ের সম্মুখীন, তাহলে তিনি উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন। পুতিন তার পারমাণবিক অস্ত্রকে উচ্চতর সতর্কাবস্থায় রাখার আদেশ দিয়েছেন। বেশিরভাগ বিশ্লেষকই অবশ্য একমত এর অর্থ এই নয় যে তিনি এ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, রাশিয়ার নীতিতে এখন কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে।
কূটনৈতিক সমাধান
যুদ্ধ বন্ধে এখন পর্যন্ত সেরকম কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা না গেলেও এ রাস্তা যে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে সেটাও নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন, এখন অস্ত্রের ভাষায় কথা হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু আলোচনার পথ সবসময়ই খোলা রাখতে হবে। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে, রুশ ও ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিরা বেলারুস সীমান্তে বৈঠকও করেন। এতে হয়তো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি, কিন্তু বৈঠকের প্রস্তাবে পুতিনের রাজি হওয়ায় এটা বোঝা যায় যে, তিনি আলোচনার মাধ্যমে একটা যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেননি। কূটনীতিকরা বলছেন, রুশ নেতার এটা বোঝা দরকার যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলতে হলে তাকে বিনিময়ে কী করতে হবে, যাতে একটা মুখ-রক্ষা করার মতো চুক্তি করা যায়। যুদ্ধের ময়দানে হঠাৎ করে রাশিয়ার অবস্থা প্রতিকূল হয়ে পড়তে পারে, যা পুতিনকে বিচলিত করে তুলতে পারে। তিনি হয়তো ভাবতে শুরু করলেন যে, পরিস্থিতি এখন সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তিনি ভাবতে পারেন যে, এই যুদ্ধ থামালে তা যতটুকু অপমানজনক হবে, তার চেয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা তার নেতৃত্বের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর হবে। তখন পুতিনকে এই সংকট থেকে বেরুনোর রাস্তা খুঁজতে হবে। যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষও মনে করল যে, রাজনৈতিক আপস রফা করাটাই হবে উত্তম বিকল্প। তখন কূটনীতিকরা মাঠে নেমে একটা চুক্তি তৈরি করলেন। ধরা যাক; এমন হলো যে, ইউক্রেন ক্রিমিয়া ও দনবাসের কিছু অংশের ওপর রুশ সার্বভৌমত্ব মেনে নিল, বিনিময়ে পুতিন ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির অধিকারকে মেনে নিলেন। এখন হয়তো এটা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না; কিন্তু এই রক্তাক্ত সংঘাত থেকে এমন একটা সমাধান বেরিয়ে আসা অসম্ভব কিছু নয়।
পুতিন ক্ষমতাচ্যুত
ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন অভিযান শুরু করার সময় বলেছিলেন, ‘আমরা যে কোনো পরিণতির জন্য তৈরি।’ কিন্তু সে পরিণতি যদি এই হয় যে, পুতিনকেই ক্ষমতা হারাতে হলো? এখন হয়তো মনে হচ্ছে যে, ব্যাপারটা অচিন্তনীয়। কিন্তু এখন দুনিয়া বদলে গেছে, এরকম একটা সম্ভাবনার কথাও ভাবা হচ্ছে। লন্ডনের কিংস কলেজের ওয়ার স্টাডিজের অধ্যাপক স্যার লরেন্স ফ্রিডম্যান এক নিবন্ধে লিখেন, ‘এটা এখন খুবই সম্ভব যে কিয়েভ এবং মস্কো—যে কোনোখানেই ক্ষমতার পটপরিবর্তন হতে পারে।’ এ কথা বলার কারণ সম্ভবত এটাই যে পুতিন এক বিপর্যয়কর যুদ্ধে নেমেছেন। এতে হাজার হাজার রুশ সৈন্য মারা যেতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ডেকে আনতে পারে দুর্ভোগ। পুতিন জনসমর্থন হারাতে পারেন। হয়তো একটা গণবিপ্লবের হুমকিও সৃষ্টি হতে পারে। তিনি হয়তো বিরোধীদের দমনের জন্য রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এটা তিক্ততা সৃষ্টি করতে পারে এবং রাশিয়ার সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিট শ্রেণি পুতিনের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব এটা স্পষ্ট করে দিতে পারে যে, যদি পুতিন বিদায় নেন এবং তার জায়গায় একজন অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থি নেতা আসেন, তাহলে রাশিয়ার ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হতে পারে, স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। হয়তো রাশিয়ায় একটা রক্তাক্ত প্রাসাদ অভ্যুত্থান ঘটে যেতে পারে। পুতিন উৎখাত হতে পারেন। এমন কিছু যে ঘটবে তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু পুতিনের কারণে যারা লাভবান হয়েছেন তারাই যদি মনে করেন যে, তিনি আর তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছেন না, তাহলে সেরকম কিছু ঘটে যেতেই পারে।
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪