পাপলু রহমান
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশ্লেষণ

জৌলুস হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব নেতৃত্বে আসবে কে

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি : সংগৃহীত
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বের ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ একসময় যেসব স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করেছিল, সেগুলো এখন বড় ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, যুক্তরাষ্ট্র ছিল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গঠন, মুক্ত বাণিজ্য প্রচার ও নিরাপত্তা জোট রক্ষা করার ক্ষেত্রে প্রধান শক্তি। তবে সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন- বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে এ ব্যবস্থা কতটা টিকবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। চীন, রাশিয়া ও বহুপাক্ষিকতাবাদের উত্থানে বৈশ্বিক ব্যবস্থা এখন দুর্বল হয়ে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের পতন এবং ট্রাম্পের প্রভাব

বিশ্বের ২০তম শতাব্দীর অধিকাংশ সময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও সামরিক জোট ন্যাটো গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখা গেছে। তবে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি থেকে মার্কিন নীতি একটি বদলে গেছে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতাকে দুর্বল করেছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে সরে আসা, ন্যাটোকে দুর্বল করা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারদের ওপর শুল্ক আরোপ করার মতো সিদ্ধান্তগুলো বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা নড়েচড়ে দিয়েছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষপাত বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসী পদক্ষেপের দৃঢ় নিন্দা না করা ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের সংশয় প্রকাশ পশ্চিমা ঐক্যকে দুর্বল করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে।

চীনের উত্থান

যখন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক নেতৃত্বের ভূমিকা থেকে পিছিয়ে আসছে, চীন ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করছে। কয়েক শতাব্দী পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার পর, চীন আবারও একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে উঠছে। শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ (বিআরআই) মাধ্যমে চীন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অংশে তার প্রভাব বিস্তার করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ, নৌবাহিনী আধুনিকায়ন ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে চীন পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেছে। একইসঙ্গে চীন একটি বিকল্প শাসন ব্যবস্থা প্রচার করছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্বৈরাচারী স্থিতিশীলতা প্রাধান্য পায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের উদার গণতান্ত্রিক আদর্শের বিপরীত।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা শুধু সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিযোগিতা নয়, এটি আন্তর্জাতিক আদর্শের প্রতিযোগিতাও। চীন যদি তার উত্থান অব্যাহত রাখে, তাহলে বৈশ্বিক নীতিমালা পরিবর্তিত হতে পারে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অব্যাহত হস্তক্ষেপের পরিবর্তে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রাধান্য পাবে না।

রাশিয়ার কৌশলগত লাভ

এদিকে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার সুবিধা নিয়ে রাশিয়া তার প্রভাব বিস্তার করছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া পরবর্তী যুদ্ধোত্তর ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। মস্কো একটি হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেছে, যেখানে প্রচলিত সামরিক কৌশলের চেয়ে সাইবার আক্রমণ, মিথ্যা তথ্য প্রচার ও রাজনৈতিক চক্রান্তের মাধ্যমে পশ্চিমা ঐক্যকে দুর্বল করা হচ্ছে। ট্রাম্পের রাশিয়ার প্রতি মনোভাব বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। ন্যাটো সম্পর্কে ট্রাম্পের সংশয় পুতিনকে উত্সাহিত করেছে, যা পশ্চিমা প্রতিরোধের শক্তি কমিয়েছে। এর ফলে এখন ইউরোপকে তার নিরাপত্তা কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হয়েছে।

বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা

বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান যেমন জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ঐতিহাসিকভাবে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছিল। তবে এখন সেগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। সিরিয়া যুদ্ধ ও রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। মূলত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো শক্তির কারণে ব্যর্থ হয় সংস্থাটি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধ সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে ডব্লিউটিও। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকও এখন চাপে, কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও বেশি প্রভাব চায়। যুক্তরাষ্ট্রের কম প্রতিশ্রুতি এবং চীন ও রাশিয়ার চাপের ফলে বহুপাক্ষিক শাসনের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। যদি এসব প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে বিশ্বের প্রবণতা আঞ্চলিক শক্তি গোষ্ঠী বা অঞ্চলভিত্তিক শক্তির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এতে ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে।

সংকটে ইউরোপ

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের অভাবে ইউরোপ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে। ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপীয় দেশগুলো মার্কিন সামরিক সুরক্ষার ওপর নির্ভর করত, কিন্তু রাশিয়ার বেড়ে ওঠা হুমকি এবং মার্কিন সমর্থন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে ইউরোপের নেতারা এখন তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা পুনর্বিবেচনা করছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ‘যৌথ কৌশলগত অটোনমি’ প্রস্তাব করেছেন, যেখানে ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না হয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।

এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাণিজ্য ও জলবায়ু নীতিতে একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক প্লেয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। তবে অভ্যন্তরীণ বিভাজন যেমন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ব্রেক্সিট, একীভূত অবস্থানে থাকাকে কঠিন করে তুলেছে। যদি ইউরোপ তার প্রতিষ্ঠান ও সামরিক ক্ষমতা শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হয়, তবে বড়-শক্তিগুলোর নজর পড়বে সেখানে। ফলে বৈশ্বিক শাসন স্বাধীনভাবে এগোতে পারবে না।

ইতিহাসের শিক্ষা এবং বিশ্বব্যবস্থার ভবিষ্যৎ

ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করে। রোমান ও চীনা সাম্রাজ্য একসময় তাদের সামরিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক একীকরণ ও সম্মিলিত নিয়মের মাধ্যমে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদেরও পতন হয়েছে। বর্তমান আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা (১৯৪৫ সাল থেকে স্থিতিশীল ছিল), তা এখন একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

বিশ্ব নেতাদের অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য যতটুকু সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা সম্ভব তা চালিয়ে যাওয়া। বর্তমানে এ অস্থিরতা শুধু আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার অবসানের প্রতিফলন কিনা, নাকি এটি একটি অস্থায়ী অস্থিরতা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। যদি ট্রাম্পের মতো আর কোনও জাতীয়তাবাদী নেতা ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল নেতৃত্ব আরও দুর্বল হতে পারে। তবে অন্য কোনও নেতৃত্বে পুনরায় যদি আন্তর্জাতিক জোট ও বহুপাক্ষিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতি দৃঢ় হয়, তবে কিছু স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

শুধু তাই নয়, চীনের উত্থান ও রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব বিশ্বব্যাপী দৃশ্যপট গঠনে প্রভাব ফেলবে। দেশগুলোকে তাদের আঞ্চলিক জোট শক্তিশালী করতে, প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে এবং অর্থনৈতিক অংশীদারত্বে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ১৯৪৫ সালের আগেও বিশ্বব্যবস্থা চিরস্থায়ী ছিল না এবং এর স্থায়িত্বও অনিশ্চিত।

বিশ্বব্যবস্থার ভবিষ্যৎ শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে জাতিগুলো এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে চলবে। ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, অসুবিধা ও বিশৃঙ্খলার সময়কাল পেরিয়ে তারপর নতুন স্থিতিশীলতা আসবে।

তথ্যসূত্র : রয়টার্স, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ফরেন অ্যাফেয়ার্স, সিএফআর

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জকসু নির্বাচন / শহীদ সাজিদের কবর জিয়ারত করল ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল

জকসু উপলক্ষে ৯ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ থাকবে উন্মুক্ত লাইব্রেরি

ভাঙল শতরানের জুটি, শততম টেস্টে হাসল মুশফিকের ব্যাট

যে কারণে বাংলাদেশের পরবর্তী ম্যাচ খেলতে পারবেন না রাকিব-তপু

আজ বিশ্ব পুরুষ দিবস

দীনেশ চন্দ্র পালের আত্মার চিরশান্তি কামনায় প্রার্থনা সভা

একটানে জালে উঠল ২০০ মণ ইলিশ

এত বড় তারকা হয়েও হামজার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই : পাপ্পু

ঘরে বসেই মেট্রোরেলের কার্ড রিচার্জ করবেন যেভাবে

বিএনপিসহ ৬টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির বৈঠক চলছে

১০

নিউইয়র্কে ফ্ল্যাট, হীরাখচিত মুকুট ও ব্যক্তিগত বিমান, মিথিলা কি পাবেন সেই স্বপ্নের চাবি?

১১

বিজয় দিবস উদযাপনে কোনো ধরনের নাশকতার শঙ্কা নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১২

গাজীপুরে কারখানায় ভয়াবহ আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৯ ইউনিট

১৩

ডিআরইউ ক্রিকেটে কালবেলার বিশাল জয়, ম্যান অব দ্যা ম্যাচ শেখ হারুন

১৪

মেজর জলিল ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি : রাশেদ প্রধান

১৫

মডেল-অভিনেত্রী জিনা লিমার রহস্যময় মৃত্যু

১৬

খাসোগি হত্যার বিষয়ে কিছুই জানতেন না সৌদি যুবরাজ : ট্রাম্প

১৭

তারেক রহমানকে নিয়ে ‘সংকট সংগ্রামে সাফল্য’ শীর্ষক তথ্যচিত্র মুক্তি পাচ্ছে বৃহস্পতিবার

১৮

তারেক রহমানের জন্মদিনে ছাত্রদলের দোয়া ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণের নির্দেশ

১৯

নির্বাচন উৎসবমুখর করতে সেনাবাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন : প্রধান উপদেষ্টা

২০
X