কাতারে অবস্থিত আল উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইরান ও ইসরায়েল।
যদিও ওই হামলায় ঘাঁটির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, যা হামলার আগেই পুরোপুরি খালি বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। যে কারণে প্রশ্ন উঠেছে - কেন প্রতিবেশী উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোতে অবস্থিত অন্যান্য মার্কিন ঘাঁটি বাদ দিয়ে এই বিশেষ ঘাঁটিকেই বেছে নিল ইরান? কুয়েত, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি নয় কেন?
এ বিষয়ে ইরানের সামরিক ও কৌশল বিষয়ে বিশ্লেষক হুসেইন আরিয়ান বিবিসি আরবিকে বলেছেন, ইরান সম্পূর্ণরূপে অবগত ছিল যে ঘাঁটিটি খালি। ইরানে ইসরায়েলের আক্রমণের আগে ওয়াশিংটন বেশ কয়েকটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে কাতারে তাদের ঘাঁটির কর্মীদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের বিষয়টিও ছিল।
হুসেইন আরিয়ানের ব্যাখ্যা, ‘ভৌগোলিকভাবে বলতে গেলে, কাতার ইরানের খুব কাছে। আল উদেইদ ঘাঁটি ইরানি উপকূল থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সম্ভবত এর থেকে সবচেয়ে সহজ আর নিকটতম লক্ষ্যবস্তু নেই।
উল্লেখ্য, আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি, যেটি আবু নাখলা বিমানবন্দর নামেও পরিচিত, কাতারের রাজধানী দোহার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঘাঁটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অবস্থিত বৃহত্তম মার্কিন বিমানবাহিনী স্থাপনা।
সবশেষ ২০২২ সালে আপডেট করা অ্যাক্সিওস প্রকাশিত তথ্য মতে, আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন বাহিনীর সেনা সংখ্যা ৮ হাজারে পৌঁছেছে। ঘাঁটিতে মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ড এবং মার্কিন বিমানবাহিনী কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদর দপ্তরও রয়েছে।
কুয়েত, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে কেন বাদ দেওয়া হলো?
অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলিতে মার্কিন স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু না করার বিষয়ে ইরানের সাবেক নৌ কর্মকর্তা হুসেইন আরিয়ান বলেন, ‘বাহরাইনের খলিফা বিন সালমান বন্দরের মতো নৌঘাঁটিতে আঘাত করা ইরানের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে, যেখানে মার্কিন পঞ্চম নৌবহর ও মার্কিন নৌ-কেন্দ্রিক কমান্ড অবস্থিত। কারণ এটি একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং কাতারের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত আল উদেইদ ঘাঁটির তুলনায় অনেক ছোট।’
মানামার পূর্বে জুফাইর এলাকার খলিফা বিন সালমান বন্দরে বিমানবাহী রণতরীসহ মার্কিন অনেক যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। সেইসঙ্গে এতে ৪টি মাইন প্রতিরোধক জাহাজ, দুটি রসদ সহায়তা জাহাজ এবং বেশ কয়েকটি মার্কিন কোস্টগার্ড জাহাজও রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে মার্কিন ঘাঁটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হুসেইন আরিয়ানের ব্যাখ্যা - আবুধাবির কাছে আল ধফরা বিমান ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করা, যেখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে, কাতারের ঘাঁটির তুলনায় ইরানের ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইরানি কর্মকর্তারা অত্যন্ত নির্ভুল বলে দাবি করেন, তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে ব্যর্থ হতে পারে এবং আল ধফরা ঘাঁটির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে’, বলেন তিনি।
অন্যান্য বিশ্লেষকও হুসেইনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন, যাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং উপসাগরীয় বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ বাবৌদ এবং ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের প্রভাষক ড. হাসান মনিমনেহ রয়েছেন।
ড. হাসান মনিমনেহ জোর দিয়ে বলেন, ইরানের আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি বেছে নেওয়া একটি ‘প্রতীকী তাৎপর্যপূর্ণ’।
ড. মনিমনেহ প্রশ্ন করেন, ‘কেন ইরান কুয়েতের স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করবে এবং তাদের বিরোধিতা করবে, যেখানে এই অঞ্চলে কাতারের কার্যকর সমঝোতা এবং মধ্যস্থতার প্রমাণ রয়েছে?’
‘ইরান সম্ভবত আত্মবিশ্বাসী ছিল না যে কুয়েতে সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে, সামরিকের পরিবর্তে সরকারি প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হবে কিনা। তেহরান হয়তো আত্মবিশ্বাসী নয় যে কুয়েত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে।’
ড. মনিমনেহের মতে, কাতারে আল উদেইদের অবস্থান একটি সামালযোগ্য অবস্থান, যার অর্থ ইরান সম্পূর্ণরূপে সচেতন যে কাতার এই সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে চায় এবং দোহার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম।
তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সক্ষমতা পরীক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু ড. মনিমনেহ প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘কাতার থাকতে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে কেন পরীক্ষায় নেওয়া হবে?’
বাহরাইনে আমেরিকান স্থাপনাগুলোতে আক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে ড. মনিমনেহ উল্লেখ করেন, বাহরাইনের সঙ্গে ইরানের পরিস্থিতি ভিন্ন। মানামার সঙ্গে পরিস্থিতি ততটা মসৃণ নয়। কাতার নিন্দা জানালে ইরান সেটা মেনে নিতে পারবে, তবে তারা আশ্বস্ত থাকবে যে কাতার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং মধ্যস্থতা করবে।
আবদুল্লাহ বাবোউদেরও একই মতামত। তিনি বলছেন, ‘ইরান ওয়াশিংটনকে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে তারা এই অঞ্চলে যে কোনো মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু আল উদেইদকে বেছে নেওয়ার কারণ এটি সম্ভবত উপসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। এটি আমেরিকার জন্য একটি পরোক্ষ বার্তা।’
তার মতে, তেহরানও উপসাগরে অন্যান্য মার্কিন ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায় না।
‘বিষয়টি কেবল একটি প্রতীকী প্রতিক্রিয়া ছিল এবং কাতার-ইরান সম্পর্ক বেশ শক্তিশালী। অন্য কোনো উপসাগরীয় রাষ্ট্রের তুলনায় কাতারিদের রাগ বা ক্রোধ শোষণ করা যেতে পারে এবং কাতার এটি বোঝে’, যোগ করেন ওমানি বিশ্লেষক আবদুল্লাহ বাবোউদ।
বিষয়টি ইরানের সেই আচরণের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়, যেটি তারা ২০২২ সালে ইরাকে ইরানের বিপ্লবী গার্ড কর্পসের কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার সময় দেখিয়েছিল।
তিনি বলেন, সেই সময় ইরান ইরাকের আইন আল-আসাদ ঘাঁটিতে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করেছিল। সুতরাং, এটি আসলে একটি প্রতীকী হামলা এবং এর মধ্য দিয়ে ইরানের জনগণের মাঝেও তারা প্রচারণা চালাতে চেয়েছে যে আমরা কিছু একটা করেছি।
মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পরিণতি বিশ্লেষণ
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, উপসাগরে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলার পরিণতি বিবেচনা করতে এবং ‘ভয়াবহ পরিণতি’ এড়াতে আল-উদেইদকে বেছে নেওয়াটাই ছিল যুক্তিসঙ্গত।
এ বিষয়ে ইসরায়েল-ইরান সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এভারেট সোফার বিবিসিকে বলেন, ‘ইরান-কাতার শক্তিশালী সম্পর্কের কারণে মনে হচ্ছে, এই হামলার সমন্বয় করাটা সহজ ছিল, তাই এর পরিণতিও ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল।’
তিনি উল্লেখ করেন - রিয়াদ বা মানামার তুলনায় দোহার সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
ফলে, আল উদেইদ বেছে নেওয়ার বিষয়টিকে ইরান, কাতার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমন্বয়ের ‘সহজতা এবং দ্রুততার’ সঙ্গে সম্পর্কিত করছেন এভারেট সোফার, যদিও আল উদেইদে ইরানের হামলা সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য আগ্রহ আর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল।
সূত্র : বিবিসি
মন্তব্য করুন