ঈদের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেন যে কোনো সময় শুরু হতে পারে। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে দুই দেশের চুক্তিবদ্ধ ব্যাংকগুলোর মধ্যে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। লেনদেনে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের আবেদন সাপেক্ষে সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্র শুরু হবে বহুল আলোচিত রুপিতে লেনদেন। এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিকতারও প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এর মধ্যদিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতের রুপিতে দ্বিপক্ষীয় লেনদেনের ইতিহাস তৈরি হবে। তবে রুপির পাশাপাশি ডলারেও চলমান বাণিজ্য চালু থাকবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার অন্যতম মাধ্যম হলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত এক বছরে ডলারের দর ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এতে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে কয়েকগুণ। তৈরি হয়েছে ডলার সংকট। ফলে অনেক দেশ এখন ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের কথা ভাবছে। ইতোমধ্যে ভারত, চীন ও রাশিয়া অনেক দেশের সঙ্গে নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক। ভারতের পক্ষে রয়েছে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)। ইতোমধ্যে ব্যাংক তিনটি সব ধরনের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। এখন যে কোনো সময় রুপিতে লেনদেনে প্রস্তুত এই তিনটি ব্যাংক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিকভাবে তিনটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ইতোমধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংককে বিশেষ নস্ট্র হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে। বাকি দুটি ব্যাংকও প্রক্রিয়াধীন। দু-তিন দিনের মধ্যেই একই হিসাব খুলতে সোনালী ব্যাংক ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া আরবিআইর অনুমতি পেতে যাচ্ছে। ফলে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকরা যে কোনো সময় রুপিতে এলসি খুললেই লেনদেন শুরু হবে।
এর পাশাপাশি নতুন একটি ডেবিট কার্ড চালু করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে টাকার পাশাপাশি রুপিতেও লেনদেন করা যাবে। এই কার্ড চালু হলে বাংলাদেশিদের ডলার খরচ কমবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশিরা ভারতে ঘুরতে গিয়ে এই কার্ড দিয়ে লেনদেন করবেন বলে প্রত্যাশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যাবেন, তাদের কাছে এই দ্বৈত মুদ্রার কার্ড থাকবে, যেখানে তারা ভ্রমণের আগে ভারতীয় রুপি যোগ করতে পারবেন। একইভাবে কোনো ভারতীয় বাংলাদেশে ভ্রমণের সময় কার্ডে টাকা যোগ করে নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বিনিময় হার হবে সরাসরি টাকা থেকে রুপি বা রুপি থেকে টাকায়। গত ১৮ জুন নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে নিজস্ব ডেবিট কার্ড নিয়ে আসা হচ্ছে, এটির নাম দেওয়া হয়েছে টাকা পে-কার্ড। এই কার্ড ব্যবহার করে দেশের ভেতরে কেনাকাটা করা যাবে। এটিকে আমরা রুপির সঙ্গে যুক্ত করে ফেলব, সেই প্রক্রিয়া চলছে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশেও এই কার্ড দিয়ে লেনদেন করা যাবে। আবার কেউ ভারতে গেলে ভ্রমণকারীর ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে, সেই পরিমাণ অর্থ তিনি রুপিতে কেনাকাটা করতে পারবেন। ফলে মুদ্রার বিনিময়ের কারণে যে ক্ষতি হতো, সেটি আর হবে না। তাতে দেখা গেছে, ৬ শতাংশের মতো অপচয় কমবে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করেন ভারতে। এতে অনেক ডলার বাঁচবে।
বর্তমানে বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের ভারতে যাওয়ার সময় পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করে নিতে হয়। তারপর সেই ডলার রুপিতে ভাঙাতে হয়। কিন্তু এভাবে দুবার মুদ্রা বিনিময়ের কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছেন ভ্রমণকারীরা। কেউ এখন ১০৮ টাকা দরে ঢাকা থেকে ৫০০ ডলার কিনে কলকাতায় ভাঙালে পাবেন ৪১ হাজার রুপির মতো, এই ডলার কিনতে তার ব্যয় হবে ৫৪ হাজার টাকা। অথচ ৫৪ হাজার টাকা সরাসরি রুপিতে ভাঙালে পাওয়া যেত প্রায় ৪২ হাজার টাকা। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের ক্ষতি হচ্ছে ১ হাজার টাকার মতো।
সরকারি হিসাবে, প্রতিবছর বাংলাদেশি নাগরিকরা ভারতে চিকিৎসা, পর্যটন ও শিক্ষা খাতে প্রায় দুই বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। কিন্তু দুবার মুদ্রা বিনিময়ের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন মানুষ। রপ্তানির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণ, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি যে তিন দেশ থেকে করে থাকে, তার মধ্যে ভারত অন্যতম।
সাধারণভাবে রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে বাধা হলো, ভারত থেকে আমদানির তুলনায় সে দেশে রপ্তানি কম। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি যত বাড়বে, রুপিতে বাণিজ্যের সম্ভাবনা ততই বাড়বে। বাংলাদেশ এখন ভারতে ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানি করে। আর ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার আমদানি করে। ফলে এই পদ্ধতিতে ভারতের সঙ্গে শুধু ২০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য করা সম্ভব হবে। এর বেশি পণ্য রুপিতে কেনা যাবে না। কারণ, রপ্তানি ছাড়া রুপি পাওয়ার সুযোগ নেই। বাকিটা ডলারেই করতে হবে। সে জন্য তারা অশুল্ক বাধা দূর করে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির পরামর্শ দেন।
এই বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম কালবেলাকে বলেন, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়ে গেছে। এখন আরবিআইর অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। তিনি বলেন, ভারত থেকে আমরা বছরে দুই বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করি আর একই সময়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি করি। সেক্ষেত্রে আপাতত দুই বিলিয়ন ডলার আমাদের বাঁচবে। এটি প্রাথমিকভাবে শুরু হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে রুপি এবং টাকার লেনদেন আরও অনেক বাড়বে। এ ছাড়া টাকা-রুপির যে দ্বৈত পে-কার্ড চালু হচ্ছে, তার মাধ্যমেও আমাদের ডলারের ওপর চাপ কমবে।
মন্তব্য করুন