বিশ্ববেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ জুন ২০২৫, ০৭:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসরায়েলের সর্বাধুনিক আকাশ ব্যবস্থা যেভাবে ভাঙছে ইরান

আলজাজিরার বিশ্লেষণ
ইসরায়েলের সর্বাধুনিক আকাশ ব্যবস্থা যেভাবে ভাঙছে ইরান

ইরানে গত শুক্রবার ইসরায়েলের বিমান হামলার পর পাল্টা জবাবে তেহরান দেশটিতে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।

ইরানের কিছু হামলা ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলের আবাসিক এলাকায় আঘাত হেনেছে, যাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি তেল আবিবে অবস্থিত সুরক্ষিত ইসরায়েলি সামরিক সদর দপ্তর কিরিয়াতেও হামলার ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার ইরান দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র ও বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি পরিকল্পনা কেন্দ্রে আঘাত করেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের সবচেয়ে উন্নত ও বিশ্বের সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইতিহাস বলছে, ইসরায়েল আয়রন ডোমের মতো তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর মাধ্যমে দেশটিতে বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সফলভাবে প্রতিহত করেছে। তাহলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করছে, জানা যাক সেই প্রশ্নের উত্তর।

আয়রন ডোম কী

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে ‘আয়রন ডোম’। তবে এটি একটি বৃহত্তর বহুস্তর ও সমন্বিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নিচের স্তরমাত্র বলে জানিয়েছেন আলজাজিরার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অ্যালেক্স গ্যাটোপুলোস। জানান, আয়রন ডোম নিচু উচ্চতার রকেট থামানোর জন্য তৈরি, যেগুলো বৃহত্তর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ধরা পড়ে না। এ ছাড়া ইসরায়েলের রয়েছে বারাক-৮, ডেভিড’স স্লিং ও টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) ব্যবস্থা, যেগুলো বিভিন্ন পাল্লার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম। ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বারাক-৮ মধ্যমপাল্লার এবং থাড স্বল্প, মধ্যম ও দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করে থাকে।

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা

দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরায়েল ব্যবহার করে অ্যারো-২ ও অ্যারো-৩ ব্যবস্থা, যেমনটা বর্তমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যবহার করছে তেল আবিব। এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করেছে ইসরায়েলের রাষ্ট্রায়ত্ত ‘ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’, যার সঙ্গে যুক্ত আছে মার্কিন সংস্থা বোয়িং।

অ্যারো-২ ব্যবস্থাটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রে খানিকটা উচ্চতার ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে সক্ষম। এ ছাড়া ‘আকাশ থেকে আকাশ’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে ইসরায়েল। এ ব্যবস্থায় ধেয়ে আসা ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে আকাশ থেকে ধ্বংস করে তারা। ইন্টারসেপ্টর (আক্রমণ প্রতিহতকারী ক্ষেপণাস্ত্র) যদি কমে যায়, তাহলে আর বেশিসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করা যায় না। এ ছাড়া কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই শতভাগ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে পারে না।

আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত— রাডার ব্যবস্থা, কমান্ড সেন্টার ও প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র-সংবলিত লঞ্চার।

লন্ডনের কিংস কলেজের পোস্টডক্টরাল গবেষক মেরিনা মিরন বলেন, শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র আসতে থাকলে প্রথমে রাডার সেটি শনাক্ত করে, পরে কমান্ড সেন্টারে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। এ সেন্টার মূল্যায়ন করে, কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা হবে। এরপর লঞ্চার সাধারণত ধেয়ে আসা কোনো ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে দুটি প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। তবে সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো ইসরায়েলের এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতেও সীমিতসংখ্যক প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র আছে। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ঠিক কতটি প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র আছে, সেটি অজানা রয়ে গেছে।

ইরান কি সত্যিই প্রতিরক্ষা ভেদ করতে পেরেছে

গত শনিবার ইসরায়েলি এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সফল। তবে শতভাগ সাফল্য কোনো ব্যবস্থাতেই নেই। এর মানে কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে। তাহলে কীভাবে সফল হলো ইরান? এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে না জানলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি সম্ভাব্য উপায়ে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ভেদ করেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ কৌশল হলো, অতিরিক্ত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র শেষ করে ফেলা।

মিরন বলেন, ‘ইন্টারসেপ্টর (আক্রমণ প্রতিহতকারী ক্ষেপণাস্ত্র) যদি কমে যায়, তাহলে আর বেশিসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করা যায় না।’

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র

আলজাজিরার বিশ্লেষক গ্যাটোপুলোস বলেন, ইরানের হাতে এখন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ক্রমাগত উন্নত ও পরিণত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারই প্রত্যক্ষ ফলাফল। কারণ, কোনো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি দেওয়ার একটি উপায় হলো, এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা, যা অতি দ্রুতগতিতে উড়ে আসে। ফলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাড়া দেওয়ার জন্য সময় অনেক কম থাকে। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো রাডারে ধরা পড়লেও প্রতিহত করা কঠিন বলে জানান মিরন।

কিছু হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে হাইপারসোনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি) সংযুক্ত থাকে। এটি একটি যুদ্ধাস্ত্র, যা শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুতগতিতে উড়তে ও দিক পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। ইরানের ‘ফাত্তাহ-২’ ক্ষেপণাস্ত্রে এইচজিভি ব্যবহৃত হয়েছে। গ্যাটোপুলোস বলেন, ‘(হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র) দেখতে একটি সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো, যার শেষ প্রান্তে একটি উড়ন্ত যান যুক্ত থাকে।’

এই প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করে বলেন, শুধু যে এইচজিভি দ্রুতগতিতে চলে তা নয়, এগুলো পথের মধ্যে আচমকা দিক বদল করে, এঁকেবেঁকে এগোয় এবং সাধারণ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো পূর্বানুমানযোগ্য পথে চলে না। এমন দ্রুত ও অনিয়মিত ধাঁচে চলাচলের ফলে এগুলো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়াতে সক্ষম হয়। কারণ, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ অনুমান করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

ইরানের অস্ত্রভান্ডারে আছে হোভেইজেহসহ বিভিন্ন ধরনের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।এগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় কম উচ্চতায়, ধীরগতিতে উড়ে যায়; অনেকটা চালকবিহীন বিমানের মতো। এ কারণে এগুলো রাডারে ধরা কঠিন হয়।

আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে

কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষক মারিনা মিরন জানান, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার আরেক কৌশল—দেখতে ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বস্তু পাঠিয়ে বা টোপ ফেলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভারাক্রান্ত করা এবং এর মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আবাসিক হোটেলে প্রেমিকাকে ধর্ষণে মৃত্যু, গ্রেপ্তার ২

মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার দাবি জাকসুর

আবুধাবিতে বাংলাদেশের বোলিং তোপে চাপে আফগানিস্তান

বিএনপি সরকারে এলে জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করবে : শামা ওবায়েদ

সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক মিসাইল উন্মোচন করল উত্তর কোরিয়া

বাগদান সারলেন তানজীব সারোয়ার

ইলিশ শিকারে গিয়ে জেলেদের সংঘর্ষ, জেলের মরদেহ উদ্ধার

নির্বাচনে কত সেনা মোতায়েন থাকবে, জানালেন মেজর হাকিমুজ্জামান

শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতার দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ

বিতর্কে জড়ালেন অনীত পাড্ডা

১০

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান পেছাল 

১১

জাতপাত বিলোপ জোটের আত্মপ্রকাশ

১২

সমাবেশের অনুমতি ছিল না, জানালেন জাপা মহাসচিব

১৩

চাকসুতে শিবির সমর্থিত প্যানেলের বিরুদ্ধে ফের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ

১৪

যে শহরে ২ ঘণ্টার বেশি ফোন ব্যবহার মানা

১৫

বিপিএলে দেখা যেতে পারে নোয়াখালী দল

১৬

‘শিশুদের নোবেল’ পুরস্কারে জন্য মনোনীত রাজশাহীর মুনাজিয়া

১৭

তরুণ প্রজন্মই আগামীর বাংলাদেশ : শরীফ উদ্দিন জুয়েল

১৮

ঘর আর নেই, তবু ঘরে ফিরছে গাজাবাসী

১৯

বাসায় বানিয়ে ফেলুন চকোলেট-কফির মজাদার মোকা কেক

২০
X