বিশ্ববেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক কোন পথে

ডয়চে ভেলের বিশ্লেষণ
যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক কোন পথে

সৌদি আরবের ডি-ফ্যাক্টো শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) আজ মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে—তেল, নিরাপত্তা, বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং সম্ভাব্য পারমাণবিক জ্বালানি সহযোগিতাসহ দুই দেশের দীর্ঘদিনের অংশীদারত্ব আরও গভীর করাই এ বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য।

জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পর এটি দুই নেতার প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির নিরাপত্তা পরিস্থিতি, ইরানের ওপর আক্রমণ, কাতারে ইসরায়েলি হামলা, আর ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের জটিল প্রেক্ষাপটে এ বৈঠককে চলমান বৈশ্বিক রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সফরটি মূলত চারটি অক্ষে আবর্তিত হবে—নিরাপত্তা সহযোগিতা, বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্ন। উভয় পক্ষই চায় সফর শেষে যেন বড় কোনো চুক্তি বা দৃশ্যমান অগ্রগতি ঘোষণা করা যায়।

লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান চাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক নিল কুইলিয়াম বলেন, উভয় দেশই একটি সফল, আলোচ্যসূচি-সমৃদ্ধ বৈঠকের চিত্র তুলে ধরতে চাইবে। এমবিএসের জন্য এটি ওয়াশিংটনে রাজনৈতিকভাবে পূর্ণমাত্রায় প্রত্যাবর্তন।

২০১৮ সালে এমবিএসের কট্টর সমালোচক জামাল খাশোগি হত্যার পর সৌদি আরব ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক মহলে এমবিএসকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার মজবুত হয়েছে।

২০২৫ সালে ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার প্রথম বিদেশ সফর ছিল রিয়াদে, যেখানে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এই বিনিয়োগ প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতকে কেন্দ্র করে সাজানো, যা দুই দেশের ঘনিষ্ঠতার নতুন অধ্যায়। এবারের ওয়াশিংটন সফরকে তাই শুধু আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়, বরং কৌশলগত অংশীদারত্বের পুনর্নির্মাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সৌদির প্রধান অগ্রাধিকার নিরাপত্তা চুক্তি: মধ্যপ্রাচ্যের টালমাটাল পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তা একটি বড় আলোচ্য। জুনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ অভিযানে ইরানের পরমাণু স্থাপনার ক্ষতি হলে কয়েকদিনের সংঘাত দেখা দেয়। সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে দোহায় হামলা চালায়। এসব ঘটনার পর সৌদি আরব আশঙ্কা করে যে, আঞ্চলিক উত্তেজনা যে কোনো সময় তাদের সীমানায় পৌঁছাতে পারে। কুইলিয়াম বলেন, ‘সৌদি আরব একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাইবে, কাতারকে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের অস্থায়ী নিশ্চয়তা দিয়েছে, তার সমতুল্য বা তার বেশি।’

ইসরায়েলের দোহা হামলার পর ট্রাম্প কাতারকে একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এমন নিশ্চিতকরণ দেন। সিনেটের অনুমোদন ছাড়াই কার্যকর হওয়ায় সৌদি আরব অস্থায়ী কিছু নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি ও স্পষ্ট মূল্যবোধভিত্তিক নিরাপত্তা চায়।

ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ এখন নয়: ২০২৩ সালের শেষ দিকে হামাস ইসরায়েল আক্রমণের আগে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি-ইসরায়েল স্বাভাবিকীকরণের কথা বলছিল। সেই প্রক্রিয়াটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। কিন্তু গাজা যুদ্ধ সবকিছু পাল্টে দেয়। এখন সৌদি আরব স্পষ্টভাবে জানিয়েছে—ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ হবে শুধু দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বাস্তব অগ্রগতি নিশ্চিত হলেই। রিয়াদের চাওয়া—ইসরায়েলকে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বারবার বলছেন যে, তিনি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান মেনে নেবেন না। তাই বিশ্লেষকদের মতে, স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে কোনো বড় ঘোষণা এখন আশা করা যায় না। কুইলিয়াম বলেন, ট্রাম্প যতই আশাবাদী হোন, এই বৈঠকে সৌদি আরব ইসরায়েল নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেবে না।

যুক্তরাষ্ট্রে চাওয়া কী: ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনা হলো—গাজায় যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা, হামাসকে নিরস্ত্র করা, ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার এবং অবকাঠামো পুনর্গঠন। এই পুনর্গঠনে সৌদি আরবকে বড় অর্থায়নের অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, সিরিয়ায় মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন উদ্যোগেও সৌদির সম্পৃক্ততা ওয়াশিংটনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

পরমাণু সহযোগিতার সম্ভাবনা ও শঙ্কা: সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে আগ্রহী। আগের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সৌদিকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিতভাবে অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনা করেছিল। তবে ইরানের সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা এবং সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তির কারণে নতুন প্রশ্ন উঠেছে।

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক মাইকেল স্টিফেন্স বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় না সৌদি স্বাধীনভাবে কোনো পরমাণু সক্ষমতা গড়ে তুলুক বা চীনের সহায়তায় এই পথে হাঁটুক। তাই বেসামরিক পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও এর সঙ্গে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ শর্ত যুক্ত থাকবে।

প্রযুক্তি নিয়ে বিরোধ: বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা এখন মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। সৌদি আরব এই প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। রিয়াদের ভিশন ২০৩০-এর লক্ষ্য উচ্চপ্রযুক্তি ও এআইকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিকে রূপান্তর করা। আর চীন সৌদির এ প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এ কারণে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে রিয়াদকেও পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা এআই এবং সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থাকবে, নাকি চীনের দিকে ঝুঁকবে?

তেল উৎপাদন নিয়ে পুরোনো বিতর্ক: দুই দেশের মধ্যে আরেকটি মতভেদ হলো তেল উৎপাদন নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র চায় সৌদি উৎপাদন বাড়াক, যাতে জ্বালানির দাম কমে। আর রিয়াদ মনে করে, দাম এখনো যথেষ্ট বাড়ানো হয়নি, তাই উৎপাদন স্থিতিশীল রাখা দরকার। বিষয়টি আলোচনায় থাকলেও সফরকে বাধাগ্রস্ত করবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মানবাধিকার ইস্যু: খাশোগি হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক বিরোধীদের আটক, মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতা—সৌদিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা মহলে উদ্বেগ রয়েই গেছে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনে এই ইস্যু খুব সামনে আসার সম্ভাবনা কম, তবুও মার্কিন কংগ্রেস এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজর থাকবে আলোচনার ওপর। স্টিফেন্সের ভাষায়, ‘কিছু মতানৈক্য থাকলেও, বৈঠকটি হবে অত্যন্ত উষ্ণ ও ফলপ্রসূ।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ওএসবি চক্ষু হাসপাতালে কাজের সুযোগ, দ্রুত আবেদন করুন

গাজায় নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুমোদন করল জাতিসংঘ

সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়িতে ভাঙচুর

ঢাকায় শীতের আমেজ, তাপমাত্রা নামল ১৮ ডিগ্রিতে

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

স্থানীয় সরকার বিভাগে বড় নিয়োগ, আবেদন যেভাবে

মঙ্গলবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৮ নভেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

মোবাইলে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ দেখবেন যেভাবে

মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছেন যুবরাজের বাবা!

১০

রাজধানীতে ককটেল বিস্ফোরণ

১১

থানায় ককটেল নিক্ষেপ, ৩ পুলিশ আহত

১২

বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের আগে মধ্যরাতে হামজার পোস্ট

১৩

‘আই ডোন্ট কেয়ার’ লেখা ফটোকার্ড পোস্ট, ঢাবির ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে থানায় সোপর্দ

১৪

ইতালিতে শীতকালীন পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত

১৫

হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ভুক্তভোগীদের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’: জাতিসংঘ

১৬

২০২৬ ফুটবল বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত যে ৩২ দলের

১৭

‘হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় যেদিন কার্যকর হবে, সেদিন আমি আনন্দিত হবো’

১৮

সাবেক এমপি হারুনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের

১৯

সড়ক অবরোধের অভিযোগে দুই ছাত্রলীগ নেতা আটক

২০
X