সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ ভাদ্র ১৪৩২
কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০৩:০০ এএম
আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০৪:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনের অশ্রুতে সিক্ত শহীদ মিনার

ওদের না পেলে ‘নতুন স্বাধীনতা’ অর্থহীন

ওদের না পেলে ‘নতুন স্বাধীনতা’ অর্থহীন

মানববন্ধন, সংহতি সমাবেশের মধ্য দিয়ে গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গুম হওয়া পরিবারের প্ল্যাটফর্ম ‘মায়ের ডাক’ মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে সেখানে জড়ো হয়েছিল স্বজনহারা বহু পরিবার। তাদের অশ্রুতে সিক্ত হয় শহীদ মিনার চত্বর।

সন্তানহারা মা, নিখোঁজ বাবার সন্তান, তুলে নিয়ে গেছে এমন ভাইয়ের বোন, বেহদিস স্বামীর স্ত্রীসহ এমন অনেকের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ছিল বেদনাবিধুর। তারা সমবেত হয়েছিলেন আপনজনদের ফিরে পাওয়ার আকুতি নিয়ে। তারা বলেন, স্বজনদের ফিরে না পেলে তাদের কাছে এই গণঅভ্যুত্থান, এই নতুন স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।

সেখানে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে স্বজনহারা মানুষ জানতে চান, তাদের স্বজনরা কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন কি না? মেরে ফেলা হলে কোথায় তাদের কবর দেওয়া হয়েছে? তারা বলেন, বাংলাদেশে যেন আর কোনো অজুহাতেই এমন অমানবিক গুমের ঘটনা না ঘটে। একজন মানুষও যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার না হন।

সমাবেশে গুম অবস্থা থেকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমা, সাবেক কূটনীতিক মারুফ জামান, সংগীতশিল্পী রানা যোগ দিয়ে নিজেদের গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি নিয়ে স্বজনরা দীর্ঘ মানববন্ধন করেন শহীদ মিনার চত্বরে। তাদের কারও সন্তান ১৩ বছর ধরে নিখোঁজ, কারও বাবাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল এক যুগ আগে। কারও স্বামীকে গুম করা হয়েছে ১০ বছর আগে। এমন অনেক পরিবার এই দীর্ঘ সময় ধরে তাদের অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা, আতঙ্ক, আর্থিক ও নানা ধরনের ক্ষতি এবং হয়রানির কথা বলেন। এসব বলতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা বলেন, এত দিন তাদের কষ্টের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। পথে দাঁড়ালেই পুলিশি হামলা করে তুলে দেওয়া হয়েছে।

মানববন্ধনে অনেক স্বজনহারা মানুষের মধ্য থেকে জামাল উদ্দিন জানান ২০১৭ সালে তুলে নেওয়া তার ছেলে ইশরাক উদ্দিনের কথা। তিনি বলেন, ছেলেকে হারানোর পর থেকে পরিবারের সব আনন্দ, উৎসব হারিয়ে গেছে।

২০১৪ সালে গুম হওয়া আবদুল কাদেরের মা আয়েশা আলীর ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় গলা ধরে আসছিল। তিনি বলেন, ‘সবাই বলছে, দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য এখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। জানি না, সে বেঁচে আছে কি না।’

ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের কন্যা মাহফুজা আক্তার বলেন, ১৫ বছর হলো তার বাবা নিখোঁজ। তাদের পরিবারটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কিশোরী লামিয়া আক্তার জানায়, ২০১৩ সালে তার বাবা কাওসার হোসেনকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তার বয়স ছিল তিন বছর। বাবার মুখটা তার মনে পড়ে না। কাঁদতে কাঁদতে বাবার মুখটা দেখার আকুতি জানায় লামিয়া। সে বলে, ‘আমি বাবার মুখটা দেখতে চাই। বাবা বলে ডাকতে চাই।’

সৈয়দা শাম্মি সুলতানা বলেন, ২০১৩ সালে তার স্বামী খালেদ হাসানকে তুলে নেওয়ার পর থেকে শুধু কান্না নিয়েই দিন কাটছে তার সংসারে। রিনা আলম জানান, ২০১৫ সালে তার স্বামী নূর আলমকে তুলে নেওয়ার পর থেকে কত জায়গায় যে খোঁজ করতে ছুটে গেছেন, সেই যন্ত্রণার কথা। তিনি বলেন, স্বামী যদি মারাও গিয়ে থাকেন, তাহলে অন্তত তার কবরটি কোথায় আছে, তা জানতে পারলে সন্তানদের নিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারতেন। হাসিনা বেগমের ছেলে তরিকুল ইসলামকে গুম করা হয় ২০১৩ সালে। কাঁদতে কাঁদতে হাসিনা বলেন, ‘আমার পরিচয়ই হয়ে গেছে গুমের ছেলের মা।’

নিখোঁজ মাজহারুল ইসলামের বোন লাবণী বলেন, ২০১২ সালে তার ভাইকে গুম করা হয়। এতদিন তারা তাদের কষ্টের কথা ভালো করে বলতে পারেননি। রাস্তায় মানববন্ধন করতে গেলে পুলিশ দিয়ে তাদের ওপর হামলা করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরাও মানুষ। আমাদের মধ্যেও আবেগ আছে, প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা আছে। আমাদের কষ্টের কথাটুকু বলতে দেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন বাহিনীর ‘আয়নাঘর’ নামে অনেক বন্দিশালা আছে। যেখানে যত আয়নাঘর আছে, সব খুলে দিয়ে বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার দাবি করেন লাবণী।

এভাবেই স্বজন হারানোর বেদনা ও কষ্টের কথা বলে তাদের মুক্তি দাবি করেন ছেলেহারা নূরুল ইসলাম, ভাইহারা মো. শহীদুল্লাহ, সন্তানহারা রেহেনা আক্তার, ভাইহারা সাঈদুল ইসলাম, বাবাহারা মিমসহ অনেকে।

মায়ের ডাকের এই সমাবেশ ও মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারাসহ ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় নেতা ফয়জুল হাকিম, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের জ্যেষ্ঠ গবেষক তাসকিন ফহমিনা, আইনজীবী সারা হোসেন, সংগীতশিল্পী সায়ান, সাংবাদিক সাঈদা গুলরুখসহ অনেকেই।

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ৫ আগস্টের পর নতুনভাবে যে জাগরণ তৈরি হয়েছে, এটিকে অনেকেই স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু এমন সময়েও যদি স্বজনহারা ব্যক্তিরা তাদের স্বজনদের ফিরে না পান, তাহলে সেই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবেদন থাকবে, দ্রুততম সময়ে স্বজনদের কাছে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দিন। আমাদের সৌভাগ্য যে, আয়নাঘর থেকে মাইকেল চাকমা ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেকেই ফিরে আসেননি। দুঃখ হয়, যখন আমরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে কথা বলে আসছি, তখন মন্ত্রীরা বলতেন ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিদেরও নাকি আমরা গুম হওয়া হিসেবে বিবেচনা করছি। গণমাধ্যমের কাছে অনুরোধ থাকবে, বিগত সময় থেকে শুরু করে আপনাদের কাছে গুম হওয়ার যত খবর আছে, সবগুলো প্রকাশ করুন, যা দেশপ্রেমিক হিসেবে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

অন্য বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে গুম হওয়ার তদন্ত করতে কমিশন গঠন করেছে এবং প্রধান উপদেষ্টা এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছেন। এটা খুবই আশাপ্রদ ঘটনা। যারাই গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত থাকুন না কেন, সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক সাজা কার্যকর করতে হবে। দেশের সব ছাত্র-জনতা এই সরকারের সঙ্গে আছে। তারা বলেন, দেশে কোনো এলিট ফোর্সের প্রয়োজন নেই। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের সঙ্গে র্যাব জড়িত। এই বাহিনী বিলুপ্ত করতে হবে। দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি মানবিক দেশ গঠন করতে হবে।

সমাপনী বক্তব্যে মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালে তার ভাইকে গুম করা হয়েছে। তখন থেকেই গুম হওয়া স্বজনদের নিয়ে এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এতদিন তারা তাদের বেদনার কথা বলতে পারতেন না। অবিলম্বে সব আয়নাঘর, সব বন্দিশালা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের অর্থে কোনো বাহিনী যেন কোনো বন্দিশালা গড়ে তুলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। গুম হওয়া মানুষদের মুক্তি ও তাদের বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করতে হবে।

বিকেলে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে বিএনপির উদ্যোগে সংহতি সভা হয়। এতে বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা তাদের কষ্টের আর্তি মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করলে হাজার হাজার নেতাকর্মী অশ্রুসজলে সহমর্মিতা জানান। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম’।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিপিএলে ইতিহাস গড়ে ফ্যালকনসকে জেতালেন সাকিব

নতুন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন / মাত্র ১০০ টাকায় করা যাবে দক্ষতা, চাকরি কিংবা ভর্তি প্রস্তুতির কোর্স

সড়কের মাঝখানে গাছ রেখেই ঢালাই সম্পন্ন 

বুটেক্স সাংবাদিক সমিতির ৯ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত

টানা ৮ ঘণ্টা অবরুদ্ধ জবির ভিসি

৬৪ জেলার নেতাকর্মীদের নতুন বার্তা দিল এনসিপি

ম্যানইউর জয়হীন ধারা অব্যাহত, এবার ফুলহামের মাঠে ড্র

ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-পেশাজীবীদের নিয়ে ‘আগামীর পথ’ অনুষ্ঠিত

প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের অনন্য কীর্তি

জুলাই যোদ্ধা শহীদ তানভীরের চাচা খুন

১০

ভরা জোয়ারে ডুবে যায় বিদ্যালয়, শঙ্কায় অভিভাবক-শিক্ষার্থী

১১

যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন তৌহিদ আফ্রিদি

১২

তারের পর এবার চুরি হলো সেতুর রিফ্লেক্টর লাইট

১৩

‘এবার আমাদের পালা’ স্বরূপ আচরণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে : টিআইবি

১৪

ভূমি অধিগ্রহণে আটকে আছে ইউলুপ, ইউটার্নে মরছে মানুষ!

১৫

কনে দেখতে যাওয়ার পথে নৌকাডুবি : নিখোঁজ দুজনের মরদেহ উদ্ধার

১৬

থাইল্যান্ডের ক্লাবে আবার ভাইরাল ‘কাঁচা বাদাম গার্ল’ অঞ্জলি

১৭

চাকসুতে সমকামিতা সমর্থক ও মাদকাসক্তদের প্রার্থিতা বাতিলের দাবি

১৮

ঠাকুরগাঁওয়ের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১

১৯

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১০ শয্যার এইচডিইউ উদ্বোধন

২০
X