বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:২৬ এএম
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুদ্ধাপরাধের ৩০ মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত!

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল
যুদ্ধাপরাধের ৩০ মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত!

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৫১টি মামলার রায় ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল। এসব রায়ে দণ্ডিত হয়েছেন ১৩১ জন। এর মধ্যে ৯১ জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় শেষে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ৫০টি আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালে এখনো ওই সময়ের ৩০টি মামলার বিচার চলছে। এসব মামলায় আসামি ১৭২ জন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ছাত্র হত্যা, লাশ পুড়িয়ে ফেলা, হেফাজত নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যার অভিযোগে নতুন করে ১৪টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়। এসব অভিযোগ তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আসবে।

এমন এক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—আওয়ামী লীগ শাসনামলে দায়ের হওয়া পুরোনো মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে এর প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকের স্কাইপি কেলেঙ্কারি, সাক্ষীদের জোর করে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা, গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে রায় লিখে দেওয়ার মতো নানা ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত জুনে যুদ্ধাপরাধের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত চৌধুরী মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের আদালতে তার পক্ষে রায় পেয়েছেন। ২০১৩ সালে এই ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হওয়ায় তাকে যুদ্ধাপরাধী বলায় ৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানহানি মামলা করেছিলেন তিনি। ওই মামলার রায়ে লন্ডনের সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালও এর রায় নিয়ে সমালোচনা করেন।

এমনই এক পরিস্থিতিতে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জোর করে অনেককে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে দেশ ছাড়তে হয়। নিরপরাধ মানুষকে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। তবে ওই সরকারের আমলে দায়ের হওয়া এখনো ৩০টি মামলা যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। সরকার পরিবর্তনের পর এসব মামলার ফাইল বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রসিকিউটরদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এর কোনো সফট কপিও ট্রাইব্যুনালের আইটি সেকশনে নেই। ফলে মামলার ভাগ্য কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না।

জানতে চাওয়া হলে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘পুরাতন মামলাগুলো পর্যালোচনা করে মেরিট (মামলার গ্রহণযোগ্যতার উপাদান) বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এসব মামলায় অনেক নির্দোষ ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের আগে জামিনের ব্যবস্থা করা হবে। এরপর মামলাগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে আগের ত্রিশটি মামলা আছে।‌ এগুলোর হার্ডকপি আগের আমলের প্রসিকিউটররা একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে গিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইটি সেকশনে সফট কপিও নেই। ত্রিশটি মামলার শুধু সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া গেছে। মামলাগুলোর কী অবস্থা, আমরা তা বলতে পারছি না।’

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকরা নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নসহ মানবতাবিরোধী নৃশংসতা চালায়। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। যাত্রা শুরুর ১৪ বছরে বেশ কিছু মামলার বিচার হয়েছে। কিন্তু এসব বিচার নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে মামলার সঠিক আলামত না থাকলেও সেগুলোর বিচার করা হয়েছে। সাজানো সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার হয়েছে। মামলার সংখ্যা কমে যাওয়ায় ২০১৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বিচার কার্যক্রম চলছিল। এরই মধ্যে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনে এক গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যান শেখ হাসিনা।

প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে গত ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে সংঘটিত গণহত্যার বিচারও হতে যাচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালেই। ৫ আগস্টের পর থেকে এ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় গণহত্যার ১৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি অভিযোগেই প্রধান আসামি করা হয়েছে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর তদন্ত চলছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান মো. আতাউর রহমান বলেছেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগগুলোর তদন্ত চলছে। আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। অপরাধ সংঘটনের স্পট থেকেও তথ্য সংগ্রহ চলছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে শিগগির ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হবে।’

জানতে চাওয়া হলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, ‘স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ট্রাইব্যুনালে কোনো বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে দেওয়া হয়নি, বিচারে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। জোর করে ভয়-ভীতি দেখিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে। স্কাইপি কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটেছে। অনেকদিন পরে বিচার শুরু করায় মামলার তেমন কোনো আলামত না থাকার পরও জোর করে বিচার করা হয়েছে। এ কারণে বিচার নিয়ে বারবার বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিচারে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হবে। আসামিরা চাইলে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন। নির্ভয়ে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে পারবেন। সর্বোপরি বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর গত ১৮ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরসহ ১৩ জন প্রসিকিউটর একযোগে পদত্যাগ করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের প্রসিকিউশন টিম গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন মন্ত্রণালয়। এ টিমের সদস্য সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। এদিকে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ১০ জন কর্মকর্তা ছিলেন। এর মধ্যে ৪ জন ছিলেন চুক্তিভিত্তিক। সরকার পরিবর্তনের পর তাদের চুক্তি বাতিল হয়। বর্তমানে ৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা আছেন। যারা গণহত্যার অভিযোগের তদন্ত করছেন। জানা গেছে, শিগগির তদন্ত সংস্থায় আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।

এদিকে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমের কার্যক্রম চলমান থাকলেও ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি না থাকায় বিচার কার্যক্রম থমকে আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার গত ১৩ জুলাই অবসরে গেছেন। অন্য এক সদস্য বিচারপতি হাইকোর্টে ফিরে গেছেন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে কোনো বিচারপতি নেই।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেওয়া আবশ্যক জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাড়িতে ঢুকে যুবদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

দেশের সব সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত

রাগিনী এমএমএস ৩’তে যুক্ত হচ্ছেন তামান্না ভাটিয়া

পর্তুগালের তারকা ফুটবলারের সঙ্গে চুক্তি বাড়াল ম্যানসিটি

ছবিতে কী দেখছেন, উত্তরই বলে দেবে আপনি অলস না পরিশ্রমী!

এশিয়া কাপের জন্য স্কোয়াড ঘোষণা করল বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ

 গাজায় দুর্ভিক্ষ হচ্ছে কি না, জানালেন জাতিসংঘ মহাসচিব

কেন্দ্র দখল করলেই ভোট বাতিল : সিইসি

গোপালগঞ্জে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আ.লীগের ৬ নেতার পদত্যাগ

সিপিএলে সাকিবের ব্যর্থতা চলছেই, দল হারল ৮৩ রানে

১০

কটাক্ষের শিকার আলিয়া

১১

ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের বেন গুরিয়নের ফ্লাইট স্থগিত

১২

ওজন কমাতে চা

১৩

‘কাউকে দোষারোপ করছি না’, বিভুরঞ্জনকে নিয়ে ছেলে ও ভাই

১৪

আজ ঢাকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ কত?

১৫

রাজধানীতে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত

১৬

সেরা অধিনায়ক কে? অপ্রত্যাশিত নাম বলে চমকে দিলেন দ্রাবিড়

১৭

মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু

১৮

শাহরুখের ওপর বিরক্ত বোমান ইরানি

১৯

জেনে নিন আজকের স্বর্ণের বাজারদর

২০
X