আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০০ এএম
আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উপাচার্য নিয়োগে ঘুরেফিরে রাজনৈতিক বিবেচনা

শিক্ষার্থীদের স্বার্থ উপেক্ষা
উপাচার্য নিয়োগে ঘুরেফিরে রাজনৈতিক বিবেচনা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে একে একে পদত্যাগ করেন বেশিরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে দলীয় স্বার্থ প্রাধান্য দেওয়াই এ ক্ষোভের কারণ। এরপর শূন্যতা কাটিয়ে উচ্চশিক্ষায় গতি আনতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই—এমন সৎ ও যোগ্য শিক্ষকদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জোর দাবি থাকলেও সেটি হয়নি। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘুরেফিরে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত কয়েক দশকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে অসংগতি এবং উপাচার্য নিয়োগে বিতর্কিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সুনাম হারিয়েছে। সরকার পতন আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের বড় কারণ ছিল দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে সবসময় সরকার-সমর্থিত শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বেশি দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ক্ষোভ তৈরি হয়। যে কারণে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকা অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই—এমন সৎ ও যোগ্য শিক্ষকরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন, এমনটাই আশা করেছিলেন সবাই। কিন্তু সেটি হয়নি। তবে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকলেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর আশা করেছিলাম উপাচার্য নিয়োগে দলীয় আনুগত্যের চেয়ে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা সে রকমটা দেখছি না। এ থেকে বোঝা যায়, কোনো সরকারই শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশে উপাচার্য নিয়োগের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কারা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন, সেটি বলা আছে। সেই আইনেও নির্দিষ্ট করে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। যার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। গণঅভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেয়। যার মধ্যে অন্যতম হলো উন্নত দেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি থাকতে হবে। উপাচার্য নিয়োগের শুরুর দিকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শর্ত মেনে নিয়োগ দেওয়া হলেও পরে সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সেই চিন্তায় সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করায় সবক্ষেত্রে শর্ত মানা সম্ভব হয়নি। ফলে নানা তদবিরে শিক্ষকরা উপাচার্য হয়েছেন।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় অধিশাখা-২ যুগ্মসচিব নুমেরী জামান বলেন, চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া উপাচার্য নিয়োগে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগ হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে থেকে যোগ্যতা অনুযায়ীই সরকার উপাচার্য নিয়োগ দেয়। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার উপযুক্ত ব্যক্তি আমি নই।

এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। খুদেবার্তা দিলেও উত্তর দেননি।

ইউজিসির তথ্যমতে, দেশে এই মুহূর্তে ৫৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদ ফাঁকা হয়। যার মধ্যে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রাবিপ্রবি) ছাড়া ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৫ আগস্টের পরে রাবিপ্রবির উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার পদত্যাগ করায় বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্যত অভিভাবকশূন্য হয়ে আছে। অন্যদিকে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের উপাচার্যরাই বহাল রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকার পতনের পর জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, জাতীয়, বাংলাদেশ কৃষি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটিতে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জামায়াতপন্থি শিক্ষক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নিয়োগকৃত উপাচার্য ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকদের কোনো রাজনৈতিক ফোরামে তাকে দেখা যায়নি। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পাবিপ্রবি) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (বিডিইউ) উপাচার্য জাতীয়তাবাদী আদর্শের বলা চাউর থাকলেও কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, ডুয়েটসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই কিংবা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আরও জানা যায়, নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়টির বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের সাবেক আহ্বায়ক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। বিএনপিপন্থি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এ এস এস আমানুল্লাহ হয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, গণিত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম পিরোজপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক লুৎফর রহমান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রতিনিধি দিল রওশন জিনাত আরা নাজনীন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মামুন আহমেদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) সায়মা হক বিদিশা দুজনই বিএনপিপন্থি শিক্ষক হিসেবে পরিচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। তিনি রাবি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সদস্য ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ১১ আগস্ট ফোরাম থেকে পদত্যাগ করে তিনি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বিশ্ববিদ্যালয়টির জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) শিক্ষক অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড্যাব তথা বিএনপি সমর্থিত। তার কোনো পদবি নেই। তাদের বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে বিএনপি, জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাসারাঙ্গাকে ছাড়াই শ্রীলঙ্কা দল ঘোষণা

ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের টাকা নিয়ে উধাও সমাজসেবা কর্মকর্তা

সিলেটে সাদাপাথর লুট / গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের দ্বিমত

আমাদের আদর্শগত শত্রু বিজেপি, বললেন থালাপতি বিজয়

৩৮ বছরের শিক্ষকতা শেষে অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় প্রধান শিক্ষককে বিদায়

পাঠ্যবইয়ে শেখ হাসিনার নাম হবে গণহত্যাকারী : আসিফ মাহমুদ

নির্বাচনে বিএনপির বিজয় ঠেকাতে নানা চেষ্টা চলছে : তারেক রহমান

নারী চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পাঁচ বাংলাদেশি ফুটবলার

অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের বৈঠক

রিজার্ভ বেড়ে ৩০.৮৫ বিলিয়ন ডলারে

১০

জাকসু নির্বাচন, ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ নিয়ে আসছে ছাত্রশিবির

১১

ঢাকঢোল পিটিয়ে বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার 

১২

‘আর একটা পাথর সরানো হলে জীবন ঝালাপালা করে দেব’

১৩

আমাদের দাবি না মানলে নির্বাচন হবে না : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি

১৪

মানুষ ভাত পাচ্ছে না আর উপদেষ্টারা হাঁসের মাংস খুঁজতে বের হচ্ছেন : আলাল

১৫

বিচারককে ‘ঘুষ’, বারে আইনজীবীর সদস্যপদ স্থগিত

১৬

ট্রাক প্রতীক নিয়ে নিজ এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন আবু হানিফ 

১৭

শিক্ষককে ছুরি মারা সেই ছাত্রী এখন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে

১৮

নথি সরিয়ে ১৪৬ কোটি টাকার কর ফাঁকি, কর্মকর্তা বরখাস্ত

১৯

নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা

২০
X