আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সোমবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, সেখানে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিবন্ধকতা দূর করার কোনো পরিকল্পনা দেখা যায়নি। বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচন নীতিতে থাকার কথা। একই সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে। অথচ বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এই দুটিই বড় প্রতিবন্ধকতা। এমন পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অনেকটাই কঠিন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি বছরের জুন শেষে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, রাজস্ব বোর্ডের ওপর কর আদায়ের বড় বোঝা চাপিয়ে দিলেও সংস্থাটির সক্ষমতা বাড়ানোর তেমন কোনো পরিকল্পনা দেখা যায়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে যে বাজার, সেই বাজার ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে তারও কোনো দিকনির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত বাজেটে।
আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। বর্তমানে দেশের জিডিপির আকার ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ৫০৮ বিলিয়ন ডলারে যাওয়ার কথা। তবে এই বিশাল লক্ষ্যপূরণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি দেশের জন্য বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই শিক্ষা নিয়ে বসে আছেন; কিন্তু চাকরি নেই। আবার বিপুলসংখ্যক শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন, যাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। বাজেটে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।’
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর মতে, মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে বিনিয়োগের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও কমবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে সামাজিক শৃঙ্খলা দরকার, সেটি ঠিক নেই। বাংলাদেশে সামাজিক শৃঙ্খলা চিন্তা করতে গেলে এটি কোনোভাবেই বিনিয়োগের জন্য সহায়ক নয়। একটি সমাজে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে তাহলে সেখানে বিনিয়োগের পরিবেশ থাকে না। বাংলাদেশে এখন ডাবল সমস্যা। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আর অন্যটি অস্থিতিশীলতা। এ দুটির সমন্বয়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুবই কম।’
মিন্টু বলেন, ‘দেশের সেভিংস কমে যাচ্ছে। কারণ ৩ বছর ধরে আমাদের মূল্যস্ফীতি প্রকৃত মজুরি থেকে বেশি। অর্থাৎ আমাদের দেশের মানুষের খরচ বেশি, আয় কম। একটা সমাজে যদি আয় কম হয় এবং খরচ বেশি হয় তাহলে কোনো সঞ্চয় হওয়ার সুযোগ থাকে না। সঞ্চয় কমে গেলে বিনিয়োগ করতে কে আসবে? যে কোনো দেশে বিনিয়োগের ৯৭ শতাংশ আসে নিজস্ব সঞ্চয় থেকে। আমাদের দেশে গত বছর সঞ্চয় কমে গেছে এবং দিন দিন সঞ্চয় আরও কমছে। যত সঞ্চয় কমবে, তত বিনিয়োগও কমে যাবে। এতে কর্মসংস্থান আরও সংকোচন হবে।’
নতুন বাজেটে খাদ্য ও কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত থাকলেও অন্য খাতে কর ছাড় সংস্কৃতি বন্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। তার ভাষায়, ‘আমি প্রতিটি কর ছাড় বাতিল করতে চাই। প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫.৬ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের লক্ষ্য ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বারবার ভর্তুকি কমানোর ওপর জোর দিয়ে আসছে, তারপরও সরকার বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি কিছুটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ হতে পারে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাজেটটি বাস্তববাদী কাঠামোয় সাজানো হলেও তা বাস্তবায়নে সক্ষমতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন কালবেলাকে বলেন, ‘এটা সংকটকালীন পরিমিত বাজেট। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় আমাদের ব্যয় সংকোচন করতে হবে। না হলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও উসকে দেবে। এ ছাড়া আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও অনেক কম। সরকার বড় বাজেট দিতে গেলে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ করা, সঞ্চয়পত্র বা বিদেশি ঋণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। সব মিলিয়ে যে বাজেট দিয়েছে সেটা ঠিকই আছে।’
ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কমিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় নামানো হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও বরাদ্দ কমে হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আয়করে ছাড় না থাকলেও বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর বাড়ছে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর নতুন চাপ তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, এই বাজেট একদিকে সাহসী আবার অন্যদিকে গতানুগতিক। সাহসী হচ্ছে, ট্যাক্স বসানোর দিক থেকে। আবার ব্যয়ের ক্ষেত্রে গতানুগতিক। তবে শতভাগ গতানুগতিক না হলেও সার্বিকভাবে ব্যয়ের দিক থেকে গতানুগতিক।
তার মতে, ‘আমাদের ব্যবসায়ী শ্রেণি খুবই শক্তিশালী। সে ধরনের প্রেক্ষাপটে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি ব্যাপক হারে কমিয়েছে। এগুলো ব্যবসায়ীদের খুবই অপছন্দ হবে। অন্যদিকে, আমদানির বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে। অর্থাৎ স্থানীয় বাজারভিত্তিক পণ্যগুলোর যে সুরক্ষা ছিল, সেটা ভেঙে গেল। এর কারণে সরকার ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়তে পারে।’
ড. জাহিদ বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা খাতে মূলত বাজেট কমেনি। এটা গণনায় কমেছে। আগে সরকারি পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদের ব্যয়সহ অনেক খাত এর মধ্যে ধরা হতো। এখন এসব ব্যয় অন্য খাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এটা অ্যাকাউন্টিং চেঞ্জ। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য সেগুলোতে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। যেমন—বয়স্ক, বিধবাসহ অন্যান্য খাতে বাজেট বেড়েছে।
বাজেটে বৈদেশিক ঋণ বাড়লেও তা মেগা প্রকল্পে নয়। মূলত বিদ্যুৎ ও রুরাল রিকভারি খাতে এই অর্থ ব্যয় হবে। অর্থ উপদেষ্টার ভাষায়, ঋণ নিয়ে হলেও গুছিয়ে নিতে হবে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেও স্থবিরতা। মেশিন আমদানি ও এলসি খোলার হার কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় কিছু খাতে শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব থাকছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রথম থেকে নবম গ্রেডভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের জন্য ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা আসতে পারে। চলমান আটটি ভাতা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতার পরিমাণ ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমে নতুন সংযোজন হিসেবে তাদের সন্তানদের জন্য মাসিক উপবৃত্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে প্রতি বছর পাঁচ মাস ধরে ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে কম দামে চাল বিক্রি করা হয় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায়। আগামী বাজেটে এ কর্মসূচি বাড়িয়ে ছয় মাস করা হচ্ছে এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ৫৫ লাখে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, এই বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় অশনিসংকেত হলো ক্রেডিট এবং লিকুইড মানি, যেটা ছাড়া তারা চলতে পারবেন না। অন্যদিকে, আমদানি খরচ আরও অনেক বেড়ে যেতে পারে। যেমন অনেক আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক বসানো হয়েছে। আবার কিছু কিছু পণ্যে শুল্ক কমানোও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিট ইফেক্ট কী হবে—বলা কঠিন।
তিনি বলেন, ‘সুশাসন না থাকলে কোনো কিছুই ঠিক করা যাবে না। এই সরকারের বেশিরভাগ মানুষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। এজন্য তাদের আমরা সৎ হিসেবে ধরে নিলাম। কিন্তু তারা যদি নিজেদের কমিটমেন্ট ঠিক রাখে, তাহলে তো তারা বেশি দিন থাকছে না। এরপর তো রাজনৈতিক সরকার আসবে। এজন্য তাদের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের পরিবর্তন আশা করেছিলাম। কিন্তু সে রকম কিছুই পাইনি।’
মন্তব্য করুন