বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ আবু সাঈদের কবর থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু করেছে বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে শহীদ আবু সাঈদের কবরকে কেন্দ্র করে যাত্রার সূচনা করছে দলটি। নেতারা বলছেন, এই কর্মসূচি শুধু একটি রাজনৈতিক অভিযাত্রা নয়, এটি ন্যায়ের দাবিতে একটি দীর্ঘমেয়াদি গণআন্দোলনের সূচনা। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাষ্ট্রের সংস্কার ও নতুন সংবিধানের দাবি উচ্চারিত হয়েছে শীর্ষ নেতাদের কণ্ঠে। জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ আদায়ের লক্ষ্যে ৩ আগস্টকে ডেডলাইন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়ায় আবু সাঈদের কবর জিয়ারত ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এনসিপি নেতারা। শুনেছেন তাদের না বলা যন্ত্রণার কথা; প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেই রক্ত বৃথা যাবে না।
এরপর গাইবান্ধার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এ সময় উপস্থিত
ছিলেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ, তাসনিম জারা প্রমুখ।
রংপুর থেকে সূচনা হলেও এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়বে ৬৪ জেলায়। শুরুর দিনে রংপুর ও গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানে পদযাত্রা ও পথসভায় অংশ নেন এনসিপির শীর্ষ নেতারা। এ সময় তারা সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা, দাবি শোনেন। পরে জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে নিজেদের পরিকল্পনা ও লক্ষ্য তুলে ধরেন।
দলের নেতারা জানিয়েছেন, কর্মসূচি থেকে বিচার, সংস্কার এবং গণপরিষদের ভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন তারা। পদযাত্রার রাজনৈতিক বার্তা দিতে গিয়েই এনসিপি এবার নিজেদের নেতৃত্বকে মাঠপর্যায়ে একত্র করেছে।
জুলাই ঘোষণা আদায়ে হুঁশিয়ারি, ডেডলাইন ৩ আগস্ট
জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ আদায়ে সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ নিয়ে যে টালবাহানা শুরু হয়েছে, আমরা স্পষ্টভাবে হুঁশিয়ারি দিতে চাই, যদি সরকার বা অন্য কেউ মনে করে হাজারো লক্ষ মানুষ যারা রাজপথে নেমে এসেছিল তারা ঘরে ফিরে গিয়েছে, তাহলে আপনারা ভুল ভাবছেন।
তিনি বলেন, আবু সাঈদের কবর থেকে ঘোষণা করছি, আমরা বাংলার প্রতিটি পথে প্রান্তরে যাব। আমরা বাংলার ছাত্র-জনতা, তরুণ ও শ্রমিকদের আবারও রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানাব। আমরা ৩ আগস্ট ঢাকায় আসছি, বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় ঢুকব। জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ আমরা আদায় করে ছাড়ব।
বিচার, সংস্কার ও নতুন সংবিধান—তিন দাবি
এনসিপির শীর্ষনেতা নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের যে তিনটি প্রধান দাবি ছিল—বিচার, সংস্কার ও নতুন সংবিধান—সেই তিনটি দাবি আমি শহীদ আবু সাঈদের কবর থেকে পুনর্ব্যক্ত করছি। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের অবশ্যই এ তিনটি পথে এগোনো দরকার; বিচার, সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন। তিনি বলেন, আমাদের মাঝে হতাশা রয়েছে। আমরা এখনো বিচার দেখতে পাইনি। আমাদের যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ এবং যে সংস্কার চেয়েছিলাম, সেটিও পূর্ণতা পায়নি।
দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, যারা গণহত্যা সংঘটিত করেছে এবং বাংলাদেশের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ চাপিয়ে দিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের পুরোনো যে সংবিধান এই মুজিববাদী সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন এক সংবিধান প্রণয়ন করতে গণপরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠিত হবে।
তিনি বলেন, হাজার হাজার মানুষের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, সেই নতুন বাংলাদেশকে গড়তে অবশ্যই পুরোনো কাঠামো ভেঙে নতুন বন্দোবস্তের জন্য মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে।
গণঅভ্যুত্থান কেবল ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নয়
নাহিদ ইসলাম বলেন, শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য জুলাই আন্দোলন হয়নি। এটি শুধু সরকার পতনের আন্দোলন নয়। এটি একটি নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। গণঅভ্যুত্থান ছিল কেবল ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নয়, বরং গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার জন্য। একদলের পরিবর্তে আরেক দলের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার জন্য রাজপথে ছাত্র-জনতা রক্ত ঢেলে দেয়নি। নতুন বাংলাদেশে আমরা চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, লুটপাট, দখলদারত্বের আর কোনো সুযোগ দেব না। আমরা, আপনারা একসঙ্গে যে দেশ গড়ার ডাক দিয়েছি, সেই দেশ গড়ে আমরা আবার ঘরে ফিরব।
প্রয়োজনে আবারও রক্ত দিতে প্রস্তুত
গতকাল দুপুরে গাইবান্ধা পৌর শহীদ মিনার চত্বরে পথসভায় নাহিদ ইসলাম বলেন, এই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষ ও ছাত্র আহত-শহীদ হয়েছেন নতুন বাংলাদেশের জন্য—যেখানে বৈষম্য থাকবে না, গণতন্ত্র থাকবে। মানুষ কথা বলতে গেলে পুলিশ হামলা চালাবে না, মত প্রকাশ করতে চাইলে লাঠিপেটা হবে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইলে মানুষ প্রতিবাদ করতে পারবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেই প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়েছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের ভয় ২০২৪ সালে ভেঙে গেছে। নতুন করে কোনো ভয়ের সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠতে দেব না। শহীদরা রক্ত দিয়েছেন, প্রয়োজনে আমরা আবারও রক্ত দিতে প্রস্তুত। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আমরা রাজপথে নেমেছিলাম, তাকে উৎখাত করেছি; কিন্তু জনগণের প্রত্যাশিত নতুন বাংলাদেশ পাইনি। এবার সত্যিকারের নতুন দেশ গড়ার জন্য আন্দোলন করছি।
‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ পুনর্বহালের দাবি
শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত শেষে তার বাড়িতে যান এনসিপির নেতারা। সেখানে তারা শহীদের বাবা মকবুল হোসেন, মা মনোয়ারা বেগম, বড় ভাই আবু হোসেনসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন ও কথা বলেন। এ সময় শহীদ আবু সাঈদের বাবা-মা তাদের সন্তানের হত্যার দ্রুত বিচার এবং ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ ঘোষণার বিষয়ে নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন নেতাদের কাছে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ পুনর্বহালের দাবি জানান।
প্রথম দিনের কর্মসূচি
কবর জিয়ারত ও পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাইবান্ধা অভিমুখে রওনা দেন এনসিপি নেতারা। গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর, পলাশবাড়ী ও জেলা শহরের পৌর শহীদ মিনার চত্বরে পদযাত্রা ও পথসভা কর্মসূচি শেষে এনসিপি নেতাকর্মীরা আসেন শহীদ আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার স্থানে—রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় আরও একটি পথসভা। এরপর রংপুর নগরীর গুরুত্বপূর্ণ লালবাগ, শাপলা চত্বর ও জাহাজ কোম্পানির মোড় ঘুরে টাউন হল চত্বরে পথসভা ও গণসংযোগে অংশ নেন তারা।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন পীরগঞ্জ প্রতিনিধি মো. আকতারুজ্জামান রানা ও গাইবান্ধা প্রতিনিধি সুমন মিয়া।
মন্তব্য করুন