আঙ্গুর নাহার মন্টি
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:৩৫ এএম
আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দিল্লিতে বসে ওয়াশিংটনের বরফ গলালেন হাসিনা

বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব
দিল্লিতে বসে ওয়াশিংটনের বরফ গলালেন হাসিনা

ভারতের নয়াদিল্লিতে চলমান জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চ বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। সেইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে কিছুদিন ধরে চলা টানাপোড়েন নিরসনেও বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোটের এই সম্মেলন রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সে ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের বরফ গলাতে দিল্লির মধ্যস্থতা সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিল্লিতে পা রাখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাসিনা-মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠককে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন

বিশেষজ্ঞরা।

হাসিনা-মোদি বৈঠকের পর নয়াদিল্লি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, তারা অব্যাহত উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারতসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। ঢাকার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনার অবদানের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। এই সূত্র ধরেই আগামীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা।

এদিকে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর গতকাল শনিবার বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার অনানুষ্ঠানিক আলাপ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুই নেতাই বেশ আন্তরিকভাবে একে অন্যকে স্বাগত জানান এবং ওই আলাপের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং শেখ হাসিনার কন্যা ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) থিম্যাটিক অ্যাম্বাসাডর সায়মা ওয়াজেদ পুতুল উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তাদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় বেশ কিছু সেলফি তোলেন জো বাইডেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ হাসিনার বেশ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে বলেও জানা গেছে।

অনানুষ্ঠানিক হলেও দিল্লিতে বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সাবেক কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহি মনোভাব কিছু হলেও কমবে। এ ছাড়া ল্যাভরভের সফরও তারা পর্যবেক্ষণ করেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও আসছেন। এসব কিছুই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ও নীতি সহজে পরিবর্তন হয় না বলে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার তাগিদ দিয়ে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা চাপ অব্যাহত রয়েছে। পশ্চিমা অন্য দেশগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আহ্বানের পাশাপাশি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখলেও মার্কিন তৎপরতা চলছে বেশ সরবে। নির্বাচন ইস্যুতে ইতোমধ্যে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও নতুন ভিসা নীতি চালুসহ প্রকাশ্যে-নেপথ্যে শেখ হাসিনার সরকারকে নানা চাপে রেখেছে। অতীতেও এদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা ছিল। এবার ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ শক্তিধর দেশগুলোর সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানও ভূরাজনীতি, ভূঅর্থনীতি ও কৌশলগত ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধিরই প্রমাণ দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি বরাবরই আস্থা রাখে ভারত। দুদেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতাও বাংলাদেশের যে কোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি। প্রতিবেশী বন্ধুদেশ ভারত বাংলাদেশ ইস্যুতে এতদিন নীরব থাকলেও এখন তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। শুধু তাই নয়, গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকারের বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও শান্তির ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রেখেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরেছে। জি-২০-এর মঞ্চেও অতিথি হিসেবে শেখ হাসিনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর কাছে তুলে ধরা হয়েছে।

ঢাকা, দিল্লিসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শেখ হাসিনার ব্যাপারে দিল্লির ইতিবাচক অবস্থান ওয়াশিংটনকেও অবহিত করা হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনকে জানানো হয়েছে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব যাতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না পায়, সে ব্যাপারেও সচেষ্ট রয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার।

আরও বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশই নয়, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ুসহ বৈশ্বিক ইস্যুতেও নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যু, ইন্দো-প্যাসিফিক, ইউক্রেন যুদ্ধসহ সব সংকটে দায়িত্বশীল ভূমিকা ও ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই জি-২০ সম্মেলনে যাওয়ার আগে ঢাকা সফর করে গেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। আর সম্মেলন শেষে বাংলাদেশে আসছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ।

এ ছাড়া বঙ্গোপসাগর ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখলেই আঞ্চলিক কানেকটিভিটি ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুফল পাবে দিল্লি-ওয়াশিংটনসহ সবাই। এ মুহূর্তে কোনো ধরনের চাপে টলানোর মতো অবস্থায় বাংলাদেশ আর নেই। বরং বেশি চাপে বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে গেলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রেরই ক্ষতি হবে। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনার সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপসারণের চেষ্টাও এ অঞ্চলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রসারের পাশাপাশি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। কারণ শেখ হাসিনার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি জঙ্গি দমনের মাধ্যমে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এদিকে ভারতের গণমাধ্যমে দুদেশের নিবিড় সম্পর্কের সুফল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ভারতের সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে একমাত্র শেখ হাসিনাই ঢাকা-দিল্লির স্বার্থকে অভিন্ন ও একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করেন। তাই মোদি সরকারও শেখ হাসিনার প্রতি তাদের সমর্থন অটুট রেখেছে, যা পরিবর্তন হওয়ার নয়।

এদিকে নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার এই ভারত সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। গত তিন মেয়াদেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে ভারত। এবারও ঢাকাকে ভোটের মাত্র তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করে নেওয়ার প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে দিল্লি। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাকে ‘আশ্বস্ত’ করে বাংলাদেশের পক্ষে স্পষ্ট বার্তাও দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এতে দিল্লি-ওয়াশিংটনের সম্পর্কেও ঢাকার গুরুত্ব বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মনোভাব বিবেচনায় নেবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর জি-২০ সম্মেলনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়া, মোদি, বাইডেনসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং সদ্য সমাপ্ত রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর ও ইমানুয়েল মাখোঁর বাংলাদেশে আসার বিষয়টি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন ইস্যুতে বৈশ্বিক যে কোনো চাপ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর জন্য আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের গুরুত্বের কারণেই পরাশক্তিগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপে রাখলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গতিশীল রয়েছে। তাই এবারের দিল্লি সফরে প্রাপ্তি এই মোমেন্টামটা সরকারকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইতিহাসে এই দিনে কী ঘটেছিল?

অস্ট্রেলিয়ায় উদ্ভাবিত বিশ্বের প্রথম টাইটানিয়াম হার্ট মানবদেহে প্রতিস্থাপন

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

শক্তিশালী পাসপোর্টে শীর্ষে সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশের অবস্থান কত?

২৭ জুলাই : নামাজের সময়সূচি

যে ভুলে মরতে পারে টবের গাছ

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে ২৪ বছর ধরে চাকরি, অতঃপর..

ঝিনাইদহে ২৪ বছর ধরে ক্রিকেট ব্যাট বানাচ্ছেন ৩ ভাই

জামালপুরে ১০ মামলায় আসামি ২৩০৫, গ্রেপ্তার ৩২

আনোয়ারা পারকি সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ভিড়

১০

যাত্রী পারাপার কমেছে আখাউড়া স্থলবন্দরে

১১

সিলেটে ৭ চোরাই সিএনজি অটোরিকশা উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭

১২

‘সাংবা‌দি‌কের ওপর হামলা নিঃস‌ন্দে‌হে ছাত্র‌দের কাজ নয়’

১৩

রাজশাহীতে সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার ১১৬৩

১৪

ছাত্রলীগের রাজনীতি ছাড়ার ঘটনা নিয়ে সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস

১৫

তিন সমন্বয়ককে আটকের কারণ জানালেন ডিবিপ্রধান

১৬

দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আল জাজিরাকে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার

১৭

পাকিস্তানের বিপক্ষে রুদ্ধশ্বাস জয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কা

১৮

ময়মনসিংহে শিক্ষার্থীর ওপর হামলা-মারধর

১৯

নাসিক কাউন্সিলর ইসরাফিল প্রধান গ্রেপ্তার

২০
X