নূর মোহাম্মদ, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বকে নির্বাচনের প্রস্তুতি জানাবেন ড. ইউনূস

জাতিসংঘ অধিবেশন
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের নির্বাচন ও সংস্কারের বার্তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানাবেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেটিই হবে দেশের গণতন্ত্রের নতুন ভিত্তি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইন বৈঠকগুলোতে ড. ইউনূসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রস্তুতি, আর্থিক সংস্কার, মানবিক সংকট মোকাবিলা ও কূটনৈতিক সক্রিয়তা এরই মধ্যে ভিন্ন আবেদন তৈরি করছে।

নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘে রূপরেখা: স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা সংস্কার কার্যক্রম চালিয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও আস্থাহীনতার মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। তবে প্রধান উপদেষ্টা এবার জাতিসংঘে স্পষ্ট করে জানাবেন যে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক হবে।’

শফিক আরও যোগ করেন, ‘এ নির্বাচন আর পেছাবে না। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ফাউন্ডেশনাল নির্বাচন, যা পরবর্তী গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত মজবুত করবে।’

জাতিসংঘ অধিবেশনে এ বক্তব্য ঘিরে নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক মহলে এ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক: ড. ইউনূস জাতিসংঘ অধিবেশনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সফরের দ্বিতীয় দিনে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ, নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদরস আধানোম গেব্রিয়াসিসসহ একাধিক বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল—বাংলাদেশের নির্বাচন, স্বাস্থ্য বীমা সম্প্রসারণ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল উদ্ভাবন ও রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে অনুরোধ জানায়।

গণতন্ত্রের নতুন ভিত্তি: প্যারিসের মেয়র অ্যানে হিদালগোর সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য এ নির্বাচন একটি নতুন সূচনা। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা পেরিয়ে জনগণ পরিবর্তন চায়। অন্তর্বর্তী সরকার সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করছে।’ আলোচনায় তারা সামাজিক ব্যবসা, অলিম্পিক আয়োজন, নারী নেতৃত্ব ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও মতবিনিময় করেন।

এ সময় মেয়র হিদালগো বলেন, ‘আপনার নেতৃত্ব মানবিকতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য আপনার দিকনির্দেশনা বিশ্বে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে।’

পাচার অর্থ ফেরত আনতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা: বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে অন্তত ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই অর্থ ফেরত আনা গেলে দেশের উন্নয়ন খাতে তা ব্যবহার করা সম্ভব হবে। মঙ্গলবার বিকেলে নিউইয়র্কের একটি হোটেলে সাংবাদিকদের বৈঠকের বিষয়টি অবহিত করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে কারিগরি সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘অর্থ পাচার দমনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বাংলাদেশ চাইলে আমরা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে প্রস্তুত।’

এলডিসি উত্তরণে ডব্লিউটিওর পূর্ণ সমর্থন: বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু এ সময়ে বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সহায়তা জরুরি। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক ড. নগোজি অকোনজো-ইওয়েলার সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানি খাত মূলত পোশাকনির্ভর। এলডিসি সুবিধা হারালে এ খাতে বড় ধাক্কা লাগবে। তাই রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং বাণিজ্য সুবিধা বজায় রাখতে ডব্লিউটিওর সক্রিয় সমর্থন প্রয়োজন।’

মহাপরিচালক অকোনজো-ইওয়েলা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠছে। ডব্লিউটিও এ উত্তরণের সময় পূর্ণ সমর্থন দেবে।’

থেয়ারওয়ার্ল্ডের বিশেষ সম্মাননা: নিউইয়র্কে থেয়ারওয়ার্ল্ড আয়োজিত বার্ষিক শিক্ষা ডিনারে অধ্যাপক ইউনূসকে দেওয়া হয় ‘আনলক বিগ চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, সামাজিক ব্যবসা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার অসামান্য অবদানের জন্য এ সম্মাননা প্রদান করা হয়।

অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের শিক্ষাদূত ও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্য মোচনে যে প্রভাব ফেলেছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ইউনূসের ধারণা কোটি কোটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে।’

ফেব্রুয়ারিতেই ভোট, ট্রাম্পকে জানালেন ড. ইউনূস: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তজা গণমাধ্যমকে জানান, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে জানতে চেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জবাবে ফেব্রুয়ারিতেই ভোট হবে বলে এ সময় তাকে অবহিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।

অনুষ্ঠানে ইউনূস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষনেতার সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন স্পেনের রাজা ষষ্ঠ ফিলিপে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় মার্কিন বিশেষ দূত সার্জিও গরের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।

সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীলতার অর্থনীতি গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতি ড. ইউনূসের আহ্বান: বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে আরও কার্যকর অর্থায়নের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রথম দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে অর্থায়নের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চলুন আমরা এমন একটি মর্যাদা, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার অর্থনীতি গড়ে তুলি, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।’

এ বিষয়ে তিনি পাঁচটি অগ্রাধিকার তুলে ধরে বলেন, এগুলো কার্যকর করলে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য, বৈষম্য ও আর্থিক অস্থিরতার সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে। অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, ‘আমাদের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করি দারিদ্র্য একজনের স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়া তার জন্য গর্বের বিষয়, যেখানে সম্ভাবনা ও দায়িত্ব একসঙ্গে রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, চতুর্থ আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সম্মেলনে নেওয়া অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য বছরে চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণ করা চ্যালেঞ্জিং হলেও অপরিহার্য।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মেসির জোড়া গোলে নিউইয়র্ক সিটিকে উড়িয়ে দিল মায়ামি

এস আলমের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির নির্দেশ

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির বৈঠক

ইসরায়েলি দূতাবাসের কাছে বোমা বিস্ফোরণ

যমুনা গ্রুপে চাকরি, আবেদন করুন আজই

স্বর্ণ কিনবেন? জেনে নিন আজকের বাজারদর

যবিপ্রবি শিক্ষার্থী তোহার আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক জয়

আজ এক জেলায় সড়ক অবরোধ

হোটেল-ফ্ল্যাট-ছাত্রাবাসে আ.লীগের কর্মী থাকলে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ ডিএমপির

বিশ্বনেতাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখেও গাজায় ভয়াবহ হামলা

১০

৩ জেলায় নিয়োগ দিচ্ছে আকিজ বশির গ্রুপ

১১

ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রীর শরীর অ্যাসিডে ঝলসে দিল প্রতিপক্ষ

১২

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

১৩

জাতিসংঘে ট্রাম্পের উপস্থিতিতে ‘ট্রিপল নাশকতা’, তদন্তে বিশেষ বাহিনী

১৪

টিভিতে আজকের খেলা

১৫

ঢাকায় বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস

১৬

ঢামেকে রোগী ভাগাভাগি নিয়ে দালালচক্রের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ

১৭

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৮

২৫ সেপ্টেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

বঙ্গোপসাগরের সাড়ে ৪ কেজির কালো পোয়া ৭২ হাজারে বিক্রি

২০
X