

গত বছর জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সমান অপরাধী তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে ট্রাইব্যুনাল তার সাজা প্রদানে নমনীয়তা দেখিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছেন, আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনেরও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য। কিন্তু এই আসামি রাজসাক্ষী হয়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিষয়ে সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করেন। সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশে তার এই সাক্ষ্য বিচারিক প্রক্রিয়ায় আদালতকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করেছে। ফলে তাকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। সবকিছু বিবেচনায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
জানা গেছে, শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা এই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতবছরের ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করা হয়। সেদিনই মামুন দোষ স্বীকার করে সেদিন রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন।
এরপর গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত অপরাধের দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন পুলিশের সাবেকে এই মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে উল্লেখ করে গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চান তিনি। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তিনি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি চাকরি। সবসময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। চাকরি জীবনে তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। তিনি সব সময় যথেষ্ট মানবিকতা ও সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে দাবি করেন। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এত বড় গণহত্যা তার দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত হয়েছে, তার দায় তিনি স্বীকার করেন।
এ ছাড়া সেদিন শেখ হাসিনা সরকারের নানা কুকীর্তি ফাঁস করে ‘হাটে হাঁড়ি’ ভাঙেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। ২০১৪ সালের পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রাজনৈতিক মেরূকরণ, নির্বাচনের আগের রাতে বাক্সে ব্যালটভর্তি, আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় রাতের বৈঠক, র্যাবের বন্দিশালা, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে হত্যার নির্দেশ, ডিজিএফআইয়ের প্রস্তাবে সমন্বয়কদের আটক, ডিবিপ্রধান হারুনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘জিন’ ডাকা, জুলাই আন্দোলনে হত্যার নির্দেশ ও মরণাস্ত্রের ব্যবহারসহ ১৫ বছরের দুঃশাসনের বর্ণনা দেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি আমার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। প্রথমে দেড় বছর এবং পরে আরও এক বছর আইজিপি হিসেবে এক্সটেনশন দেওয়া হয়। আইজিপি পদে পদোন্নতির জন্য সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক গ্রুপিং ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রাজনৈতিক মেরূকরণ হয় এবং গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বলয় তৈরি হয়। পুলিশ অফিসাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে পড়েন। এসব কারণে সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে পুলিশকে কন্ট্রোল করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।’
জুলাই আন্দোলন প্রসঙ্গে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ট্রাইবুনালে বলেন, ‘২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাইয়ের পর প্রতিদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় রাত ৯টায় কোর কমিটির বৈঠক হতো। ১৯ জুলাই সেখানে আন্দোলন দমানোর বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওখানে আমি নিজে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাংগীর আলম, অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতান ও রেজা মোস্তফা, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, র্যাবের মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন।’
রাজসাক্ষী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সেখানে (বৈঠকে) ডিজিএফআই থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার জন্য। আমি বিরোধিতা করি, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের পরে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমন্বয়কদের আটক করে মানসিক নির্যাতন করা হয়। তাদের স্বজনদের তুলে নিয়ে আসা হয়। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ এ দায়িত্ব পালন করেন। ডিবিপ্রধান হারুনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘জিন’ ডাকতেন। কারণ তিনি সরকারের নির্দেশ পালনে পারদর্শী ছিলেন। সব জায়গায় তাকে দেখা যেত। আন্দোলনের একপর্যায়ে ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। এটি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’
ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ফোনকলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে পুলিশ ‘লেথাল উইপেন’ বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে ফোন করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
রাজসাক্ষী আব্দুল্লাহ আল-মামুন আদালতকে বলেন, ‘আমি ১৮ জুলাই দুপুরে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে বসা ছিলাম। আমাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ফোন করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপন ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ এ সময় অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার আমার সামনে উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রলয় কুমার জোয়ার্দারকে বললাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটি বলছেন। বিষয়টি নিয়ে কী করা যায়। সে সঙ্গে সঙ্গে আমার রুম থেকে বের হয়ে যায়। পরে সে ডিএমপি কমিশনার সারা দেশে এ তথ্যটি পাঠিয়ে দেয়। ওইদিন থেকে লেথাল উইপন ব্যবহার শুরু হয়। চায়নিজ রাইফেল এলএমজিতে এটি ব্যবহার শুরু হয়। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এ ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী ছিলেন। তিনি ছাড়াও আন্দোলন দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মেয়র ফজলে নূর তাপস, ব্যবসায়ী ও উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননসহ একাধিক রাজনৈতিক নেতা মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে প্ররোচিত করেছিলেন’ বলে সাবেক আইজিপি উল্লেখ করেন।
আব্দুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, “২০২৪ সালের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করে এসে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বললে সারা দেশে আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। ১৫ জুলাই ওবায়দুল কাদের ও নানক সংবাদ সম্মলেন করে আন্দোলনকারীদের দমনে ‘যুবলীগ-ছাত্রলীগ যথেষ্ট’ বলে বক্তব্য দেন। এরপর ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর নিযার্তন চালায়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মীরাও ভূমিকা রাখেন। এভাবে সময় পার হচ্ছিল।”
রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘৪ আগস্ট বেলা ১১টায় আমাকে গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, তিন বাহিনীর প্রধান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানসহ ২৭ জন উপস্থিত ছিলেন। মিটিংয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রিপোর্ট পেশ করার পর অবস্থার অবনতির খবর পাওয়া যায়। তখন মিটিং স্থগিত করা হয়। পরে আমি অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ৫ আগস্ট ছাত্রদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি দমনে রাজধানীর প্রবেশপথে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পুলিশ প্রতিরোধ করবে। পরদিন (৫ আগস্ট) সকালে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে যাই। দুপুর ১২টা থেকে ১টার দিকে জানতে পারি, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন।’
সাবেক এই আইজিপি আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল ৫টার পর আমাকে ও এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলামকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে উদ্ধার করতে হেলিকপ্টার পাঠায় সেনাবাহিনী। সঙ্গে আরও দুজন ছিল। পরদিন ৬ আগস্ট আমাকে আইজিপি পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর আমি ক্যান্টনমেন্টে আটকা ছিলাম। ৪ সেপ্টেম্বর আমাকে আটক দেখানো হয়।’ জবানবন্দিতে আব্দুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, ‘‘২৭ জুলাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমি নারায়ণগঞ্জ যাই। পথে যাত্রাবাড়ী থামলে ওয়ারী জোনের ডিসি ইকবাল আমাদের ছবি দেখিয়ে বলে, ‘স্যার একটা গুলি করি একটা মরে, বাকিরা যায় না স্যার।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় একজন পুলিশপ্রধান হিসেবে আহত ও হত্যার ঘটনায় আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি উল্লেখ করে কান্নারত অবস্থায় আব্দুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে বলেন, আমি যে নৃশংসতা দেখেছি, তাতে আমি রাজসাক্ষী হওয়াটা যৌক্তিক মনে করেছি।”
সাবেক এই আইজিপি ট্রাইব্যুনালে আরও বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে স্বজন হারানো পিতা-মাতার আহাজারি, হত্যার পর মরদেহ নৃশংসভাবে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় আমি ব্যথিত, লজ্জিত ও অনুতপ্ত এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি স্বীকার করছি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে এ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। আমি গণহত্যার শিকার প্রতিটি পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।’
রাতে ৫০ শতাংশ ব্যালট বাক্স ভরার পরামর্শ জাবেদ পাটোয়ারীর
রাজসাক্ষী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন আদালতে বলেন, ‘আমি জানতে পারি, জাবেদ পাটোয়ারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ দেন। সরকারের পক্ষ থেকে সে অনুযায়ী ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি এবং দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী উপরিউক্ত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তা বাস্তবায়ন করেন।’
ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘আমি সাবেক আইজিপি। বর্তমানে অবসরে। এ মামলায় আসামি হিসেবে জেলহাজতে আছি। আমি ১৯৮৬ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮৯ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করি। আমি চাকরি জীবনে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, সিআইডির প্রধান, র্যাব মহাপরিচালক এবং সর্বশেষ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০২২-এর ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমাকে এ মামলায় গ্রেপ্তারের পর আমি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে ইচ্ছুক হলে গত ২৪ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে বিজ্ঞ অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেনের কাছে পাঠান। আমি সেদিনই তার কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিই। পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের পর আমি দোষ স্বীকার করে পূর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করি। ট্রাইব্যুনাল সে আবেদন মঞ্জুর করেন।’
রাজসাক্ষী আবদুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। র্যাবের ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমি জানতে পারি, র্যাবের হেড কোয়ার্টার কর্তৃক পরিচালিত উত্তরার র্যাব-১-এর কমপাউন্ডের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্ক ফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। অন্য র্যাব ইউনিটের অধীনে আরও বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটক রাখা হতো, নির্যাতন করা হতো; যা একটি কালচারে পরিণত হয়েছিল। অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মতো কাজগুলো র্যাবের এডিজি (অপস/অপারেশন) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের (র্যাব ইন্ট/ইন্টেলিজেন্স) পরিচালকরা সমন্বয় করতেন। র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলে শুনেছি। এই নির্দেশনাগুলো তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীর মাধ্যমে আসত বলে জানতে পারি। এই নির্দেশনাগুলো চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের (র্যাব ইন্ট.) পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো।
ট্রাইব্যুনালে র্যাবের বিষয়ে মামুন আরও বলেন, ‘আমি র্যাবের ডিজি হিসেবে যোগদানের সময় আমার পূর্ববর্তী মহাপরিচালক বেনজীর আহম্মেদ আমাকে জানান, টিএফআই সেলে ব্যারিস্টার আরমান বন্দি আছে। আমি যোগদানের পর র্যাব ইন্টেল ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেমও আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। র্যাবের এডিজি (অপস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগে (র্যাব ইন্ট.) সাধারণত সেনাবাহিনীর অফিসার থেকে নিয়োগ করা হতো। টিএফআই সেলে ব্যারিস্টার আরমানের বন্দি থাকার বিষয়টি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর কাছে একাধিকবার উপস্থাপন করি এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চাই। তিনি আমাকে পরে জানাবেন মর্মে অবহিত করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি আর কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। আমি র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে আসার সময় পরবর্তী মহাপরিচালক খুরশীদ হোসেনকে ব্যারিস্টার আরমানের বিষয়টি অবহিত করি। র্যাবে অফিসারদের মধ্যে এডিশনাল এসপি আলেপ উদ্দিন ও এসপি মহিউদ্দিন ফারুকীকে আমি চিনতাম, যারা বন্দিদের অপহরণ, নির্যাতন এবং হত্যার মতো কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিল।’
র্যাবের বিষয়ে মামুন ট্রাইব্যুনালে আরও বলেন, ‘আলেপ উদ্দিন প্রথমে নারায়ণগঞ্জে ছিল। পরবর্তী সময়ে র্যাবের এডিজির (অপস) প্রস্তাব মতে তাকে র্যাব ইন্টেলে পদায়ন করা হয়। আমি র্যাব ডিজির দায়িত্ব পালনকালে র্যাবের ডিরেক্টর ইন্টেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম, লে. কর্নেল খাইরুল ইসলাম ও লে. কর্নেল মশিউর রহমান। এ ছাড়া এডিজি (অপস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কর্নেল তোফায়েল, কর্নেল আজাদ ও কর্নেল কামরুল। আমার দায়িত্ব পালনকালে যদিও আমি র্যাব কর্তৃক মানুষকে বিনা বিচারে আটক, নির্যাতন এবং কাউকে কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো বিষয়গুলো জানতাম, কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আসত এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড মানা হতো না। র্যাবের এসব কার্যক্রমের কারণে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক র্যাব বাহিনীর ওপর এবং আমিসহ সাবেক কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন আরোপ করা হয়।’ আবদুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালকে জানান, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তার বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৯০ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
মন্তব্য করুন