

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরদিন জুলাই গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শরিফ ওসমান হাদির ওপর দুর্বৃত্তদের হামলা সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অশনিসংকেত। তপশিল ঘোষণার আগে দু-একটি আসনে প্রার্থীর ওপর হামলা ও সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি স্থানে সহিংসতার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। বরং, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার পুনর্গঠন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণ, অপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ও আইনের মুখোমুখি করা, নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি পূরণ, বিভিন্ন পর্যায়ের সোর্সগুলো সক্রিয় করা এবং সর্বোপরি অপরাধ প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়ার ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি বিদ্যমান, যা নানাভাবে দৃশ্যমান। এরূপ পরিস্থিতি অপরাধীদের সক্রিয় করছে।
এ বাস্তবতা জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রশ্নে নানা ধরনের প্রসঙ্গ সৃষ্টি করেছে। তপশিলের আগে সংঘটিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা থাকত। বাংলাদেশে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ের ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক মোড়কে, মতাদর্শ বিবেচনায় এবং ব্যক্তির প্রতি পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে নানাভাবে মূল্যায়ন করা হয়। এই মূল্যায়নের সূত্র ধরে কোনো ঘটনা গুরুত্ব পায়। আবার কোনো ঘটনা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে বিবেচিত হয়। সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা বিচ্ছিন্ন হিসেবে বিবেচনা করার রেওয়াজ দুর্বৃত্তদের অপরাধমূলক পরিকল্পনা গ্রহণে প্রভাবিত করে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে পূর্ব-অনুকূল পরিস্থিতি থাকা প্রয়োজন এর যথেষ্ট অনুপস্থিতি রয়েছে। উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে দ্রততার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব ঘটলে অনুরূপ সংঘাত-সহিংসতা, টার্গেট কিলিং বা হামলা-পাল্টা হামলার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনেকাংশে বেড়ে যাবে।
এ হামলাগুলো নির্বাচনে প্রার্থী, প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক এবং জনগণ তথা ভোটারদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। কারণ ভোটাধিকার বা নির্বাচনের মূল্যের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। জনগণ কিংবা ভোটারদের কেউই ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ বা ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার জটিলতা সৃষ্টি করছে। ভোটাররা অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের নিরাপত্তা চিন্তা বা সংকট দ্বারা প্রভাবিত হবে। এ প্রভাব অংশগ্রহণমূলক বৈশিষ্ট্যের প্রশ্নে নির্বাচনকে পিছিয়ে রাখবে। প্রার্থীর ওপর হামলা এবং যথাযথ প্রতিকারের ঘাটতি অন্যান্য প্রার্থীকে আতঙ্কে রাখবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং প্রার্থীর ব্যক্তিক অঙ্গীকার জনগণের সঙ্গে নানা আঙ্গিকে নানা আয়োজনে আলোচনা করার এবং জনগণের মতামত গ্রহণের সুযোগের প্রশ্নে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রার্থী ও জনগণের মধ্যে উদ্ভূত আতঙ্ক নিরসনের চেষ্টা দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। এর সঙ্গে চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি সমন্বিতভাবে অর্থাৎ নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত অংশীজনের সজাগ, সতর্ক ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এই শক্তির সৃষ্টি বা জাগ্রতকরণ অতি দ্রুততার সঙ্গে করা প্রয়োজন। এটি সহজ নয়। তবে চাইলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সমন্বয় করে, এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব।
এবারের নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচন থেকে সব বৈশিষ্ট্যে ব্যতিক্রম। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের আগামী দিনের রাজনৈতিক চাহিদা পূরণ, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, কাঠামো চর্চাসহ একটি প্রত্যাশিত পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সব ধরনের অগণতান্ত্রিক অপশক্তি ও ভয়ভীতি সৃষ্টির অপচেষ্টাকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রশ্নে মোকাবিলা করতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদার্পণ নিশ্চিত হবে। জনগণ এই অপেক্ষায় রয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও সরকার দ্রুততার সঙ্গে বিষয়গুলো বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানুষের মধ্যে স্বস্তি নিশ্চিত করবে। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। গণতন্ত্রের প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। আবার নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে জন-অংশগ্রহণের প্রত্যাশাও অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
লেখক: সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সহযোগী অধ্যাপক
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন