

সুদানের স্থানীয় সময় বেলা ৩টা ৪০ মিনিট। আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে অন্যান্য দিনের মতো কর্মব্যস্ত ছিলেন শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরা। হঠাৎই শুরু হয় ড্রোন হামলা। গত শনিবারের এই হামলা চলে ১০ মিনিট ধরে। ভয়াবহ এই হামলায় প্রাণ হারান ৬ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী। আহত হয়েছেন ৮ জন।
এদিকে গতকাল রোববার পর্যন্ত শহীদ শান্তিরক্ষীদের মরদেহ কবে নাগাদ ফিরিয়ে আনা হবে, তা জানা যায়নি। মরদেহ দ্রুত ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়েছেন স্বজনরা। এই ছয়জনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
সেনাসমর্থিত সুদান সরকার এই হামলার জন্য আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) দায়ী করেছে। তবে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে আরএসএফ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতিসংঘের কোনো ঘাঁটিতে এ ধরনের হামলার নজির নেই। জাতিসংঘের মিশনগুলো সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এসব ঝুঁকির মধ্যেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিজের জীবন বাজি রেখে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন।
আবেই শহরে এক চিকিৎসকের বরাতে সংবাদমাধ্যম এএফপি জানিয়েছে, শান্তিরক্ষীরা ভবনের ভেতরে অবস্থানকালে এ ড্রোন বোমা হামলা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একটি ড্রোন থেকে এই হামলা চালানো হয়।
গতকাল হতাহতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। নিহত ছয়জন হলেন কর্পোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা (রাজবাড়ি), সৈনিক শান্ত মণ্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) ও লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)।
আহত শান্তিরক্ষীরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম, সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, সৈনিক মোসা. উম্মে হানি আক্তার, সৈনিক চুমকি আক্তার ও সৈনিক মো. মানাজির আহসান।
আইএসপিআর জানিয়েছে, আহত ৮ জন শান্তিরক্ষীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে সৈনিক মো. মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এরই মধ্যে তার সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। অন্য আহত ৭ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং তারা সবাই শঙ্কামুক্ত রয়েছেন।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে হামলায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, ‘এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশ সরকার নিহতদের পরিবারের পাশে থাকবে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস হামলাটিকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যা দিয়ে কড়া নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।’ এক বিবৃতিতে গুতেরেস বলেন, ‘দক্ষিণ কর্দোফানে শান্তিরক্ষীদের ওপর এ ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর জন্য অবশ্যই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ অঞ্চল আবেই এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন।
সুদানের প্রধানমন্ত্রী কামিল ইদ্রিস বলেন, এই সন্ত্রাসী বিদ্রোহী মিলিশিয়া একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কাদুগলি শহরটি, যেখানে গত নভেম্বরের শুরুতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়, প্রায় দেড় বছর ধরে আরএসএফের অবরোধে রয়েছে। গত অক্টোবরের শেষদিকে দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশের দখলের পর আরএসএফ পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে তেলসমৃদ্ধ কর্দোফান অঞ্চলে প্রবেশ করে। কর্দোফান অঞ্চলটি তিনটি রাজ্যে বিভক্ত।
বিশ্লেষকদের মতে, এ অঞ্চলটি সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখা ও সেনা চলাচলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরএসএফ মধ্য সুদানে সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেদ করে আবারও রাজধানী খার্তুম দখলের পথ তৈরি করতে চাইছে।
গত সপ্তাহে দক্ষিণ কর্দোফানের কালোগি এলাকায় একটি কিন্ডারগার্টেন ও হাসপাতালে হামলায় ৬৩ শিশুসহ ১১৪ জন নিহত হয় বলে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে।
‘আমার মাসুদের হাত নেই এমন একটা রক্তাক্ত ছবি দেখেছি’: শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার এক মাস সাত দিন পর সন্ত্রাসীদের হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য করপোরাল মাসুদ রানা নিহত হয়েছেন। মাসুদ রানার বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামে। স্ত্রী আসমাউল হুসনা আঁখি জানান, সর্বশেষ তার সঙ্গে শনিবার কথা হয়। পরে আবার তাকে ফোন করার কথা থাকলেও আর কোনো ফোন আসেনি। পরে রাত ১০টার দিকে জানতে পারেন স্বামী শান্তিরক্ষী মিশনে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হয়েছেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মাসুদের হাত নেই এমন একটি রক্তাক্ত ছবি দেখেছি।’
২০০৫ সালে মাসুদ রানা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সদস্য হিসেবে বগুড়া সেনানিবাসে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। মাসুদ রানা গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুদানে শান্তিরক্ষী মিশনে যান।
‘বাবা আমি ডিউটিতে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া কইরো’: ড্রোন হামলায় নিহত সেনাবাহিনীর সদস্য শামীম রেজার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গি গ্রাম। গতকাল বিকেলে শামীমের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, উঠানের সামনে বসে কান্না করছেন তার বাবা আলম ফকির। পরিবারের স্বজন ও প্রতিবেশীরাও সবাই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন শামীমের মৃত্যুর খবরে। শামীমের বাবা আলম ফকির বলেন, শুক্রবার রাতে শামীমের সঙ্গে শেষবারের মতো ভিডিওকলে কথা হয়। বাবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন শামীম। বলেছিলেন, বাবা আমি ডিউটিতে যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া কইরো।
তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে শামীম সবার বড়। বাবা আলম ফকির কৃষিকাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন। আট বছর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন শামীম। চলতি বছরের ৭ নভেম্বর শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান তিনি। দেড় বছর আগে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় বিয়ে করেন শামীম।
‘একটাই ছল হামার, তাকে মারি ফেলল!’ নিহতদের একজন লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়ার গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদিপুর ইউনিয়নের আমলাগাছি (ছোট ভগবানপুর)। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবুজ সবার ছোট। তিনি এক বছর আগে নাটোর জেলায় বিয়ে করেন।
সবুজ মিয়ার মৃত্যুর খবরে তার মা, স্ত্রীসহ স্বজনদের মাঝে মাতম চলছে। একই সঙ্গে গ্রামজুড়েই নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সবুজের মা শাকিনা বেগম বলেন, ‘একটাই ছল হামার, তাকে মারি ফেলল! তাড়াতাড়ি হামার ছলেক ফেরত চাই।’
‘আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব’: নিহত জাহাঙ্গীর আলম কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের আকন্দ বাড়ির হজরত আলীর ছেলে। প্রায় ১১ বছর আগে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। গত ৭ নভেম্বর সুদানে যান জাহাঙ্গীর।
জাহাঙ্গীরের বাবা হজরত আলী ও মা পালিমা বেগম সন্তানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন। নিহতের বাবা হজরত আলী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে যাওয়ার সময় বলেছিল আমাকে দেখে রাখতে। বলেছিল দেশে এসে টাকা দেবে, কাজ কম করতে। এখন সে নিজেই নেই, আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? আমার পরিবারের সব খরচ আমার ছেলে দিত। তার দেওয়া টাকায় সংসারের খরচ আমার এবং তার মায়ের চিকিৎসার খরচ সব কিছু চলে যেত। এখন আমাদের কী হবে।’
স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ছবি তুলতে নিষেধ করেছিল। বলেছিল এতে আজাব হবে। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব।’
৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রয়েছে শান্তর: নিহত অন্য দুই সেনা সদস্যের বাড়ি কুড়িগ্রামে। সৈনিক শান্ত মন্ডলের বাড়ি জেলার রাজারহাটে এবং মমিনুল ইসলামের বাড়ি উলিপুর উপজেলায়।
শান্তর বড় ভাই সোহাগ মন্ডল জানান, শান্ত ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করেন। তিনি সর্বশেষ বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে সৈনিক পদে ছিলেন। গত ৭ নভেম্বর তিনি শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে যান। তিনি বলেন, এক বছর আগে শান্ত বিয়ে করে। তার ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বর্তমানে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছে। শনিবার সন্ধ্যায় শান্ত ভিডিওকলে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেছে। রাত সাড়ে ১০টায় খবর পাই ওদের ক্যাম্পে হামলা হয়েছে এবং শান্তসহ আরও ৫ জন নিহত হয়েছে।
ঘটনার দিন বিকেলে পরিবারের সঙ্গে শেষ কথা হয় মমিনুলের: ২০০৭ সালে মমিনুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বাড়িতে বাবা-মা ও ভাই ছাড়াও স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। মাস খানেক মমিনুল সুদানে গিয়েছিলেন। ঘটনার দিন শনিবার বিকেলে ভিডিওকলে বাড়ির সবার সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। এলাকার সবার খোঁজ-খবরও নেন। এরপর রাত ১১টায় তার মৃত্যুর খবর জানতে পারে হতভম্ব হয়ে যায় পরিবার।
মমিনুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সবাই শোকে মুহ্যমান। প্রতিবেশীরা বাড়িতে ভিড় করছেন। তার স্ত্রী, ভাই-বোন ও মা মূর্ছা যাচ্ছিলেন। প্রতিবেশী ও স্বজনরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না।
(ঢাকার বাইরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন কালবেলার সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)
মন্তব্য করুন