

আততায়ীর বুলেটে বিদ্ধ হয়ে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারির অকুতোভয় যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ১০টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে হাদির মৃত্যু হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থানের ইতিহাস ধরে রাখতে তিনি গড়ে তোলেন ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল রাত সাড়ে ১১টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে হাদির মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন স্বয়ং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ভাষণের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি সংবাদ নিয়ে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের অকুতোভয় যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি আর আমাদের মাঝে নেই।’
দুর্বৃত্তের ছোড়া তপ্ত বুলেট প্রাণ কেড়ে নিলেও হাদির বিপ্লব চালিয়ে নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তার সহযোদ্ধারা। সুদূর সিঙ্গাপুর থেকে তার মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশ ছেয়ে যায় শোকের কালো মেঘে। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তার রাজনৈতিক সহচর, ভক্ত, অনুরাগী ও সাধারণ মানুষ। খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে তারা নামেন ঢাকার রাজপথে। শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, বাংলামটর, নিউমার্কেটসহ রাজধানীর বেশকিছু জায়গায় সড়কে নেমে আসা সহযোদ্ধারা বলেন, এক হাদির প্রাণ কেড়ে নেওয়া গেলেও তারা সবাই এখন থেকে একেকজন হাদি। এক সপ্তাহ পরও আততায়ী এবং হাদি হত্যার পরিকল্পনাকারীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তারা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
হাদির মৃত্যুর খবরে গত রাত সাড়ে ১২টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক প্রকাশ করেন। এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও গভীর শোক জানিয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ দোয়া ও আগামীকাল রাষ্ট্রীয় শোক কর্মসূচি পালনের আহ্বান করা হয়েছে। সেইসঙ্গে হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।
ওসমান হাদি ছিলেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। গত শুক্রবার তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় গণসংযোগের পর স্থানীয় একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। এরপর সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফিরছিলেন। রিকশাটি বিজয়নগরে বক্স কালভার্ট রোডে গেলে পেছন থেকে মোটরসাইকেলে আসা দুই দুর্বৃত্তের একজন খুব কাছ থেকে হাদির মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সংকটাপন্ন অবস্থায় একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। তখনই চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন ওসমান হাদি। তাকে আরও নিবিড় চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ১৫ ডিসেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। গতকাল বিকেলে ইনকিলাব মঞ্চের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছিল, ওসমান হাদি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। সিঙ্গাপুরেই তার অস্ত্রোপচারের অনুমতি দিয়েছে পরিবার। তবে রাতেই তার মৃত্যুর খবর আসে।
হাদিকে গুলির ঘটনায় হওয়া মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপ নেবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাকে গুলির পর পুলিশের পক্ষ থেকে ফয়সাল করিম মাসুদ নামে ছাত্রলীগের সাবেক এক কেন্দ্রীয় নেতার ছবি প্রকাশ করে পুলিশ। তাকে প্রধান শুটার হিসেবে চিহ্নিত করে ধরিয়ে দিতে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ লাখ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। দেশ ছেড়ে যাতে না পালাতে পারে সেজন্য সীমান্তে রেড অ্যালার্টের পাশাপাশি তার পাসপোর্টও ব্লক করা হয়। এর মধ্যে খবর বেরিয়েছে মোস্ট ওয়ান্টেড সেই শুটার ফয়সাল ও তার সহযোগী আলমগীর দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক ও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। তাদের মধ্যে প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালের বাবা মো. হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা. হাসি বেগম (৬০), স্ত্রী সাহেদা পারভিন সামিয়া ও শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু রয়েছেন। গ্রেপ্তার বাকি ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন মো. নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, মো. কবির, আব্দুল হান্নান, মো. হিরন, মো. রাজ্জাক, ফয়সালের বান্ধবী মারিয়া আক্তার এবং হালুয়াঘাট সীমান্তে মানব পাচারকারী হিসেবে পরিচিত সিমিরন দিও ও সঞ্জয় চিসিম।
ইনকিলাব মঞ্চ দিয়ে পরিচিতি পেয়ে দেশ জয় করে নেয় হাদি : জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। ইনকিলাব মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে ধারাবাহিক সমাবেশের আয়োজন করেন তিনি। বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হলেও পরে আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। দ্রুত তার একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেন তিনি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতেও ছিলেন সরব। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষেও প্রকাশ্যে মত দেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর হাদি জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিলেও পরে নতুন দল এনসিপিতে যোগ দেননি। বরং ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েক মাস ধরে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়া, বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচার, ভোটারদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ ও ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ—সবই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরতেন।
বিভিন্ন জায়গায় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ: হাদির মৃত্যুর খবরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো পত্রিকার কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও নথিপত্রে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। গত রাত ১২ টার দিকে এই হামলা চালানো হয়। প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলার পরে দুর্বৃত্তরা যায় ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে। সেখানেও ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে ডেইলি স্টারের সামনে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক জাইমা ইসলাম এক ফেসবুক পোস্টে রাত সাড়ে ১২টার পর বলেন, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, এখানে অনেক ধোঁয়া। আমি ভেতরে আটকা। তোমরা আমাকে মেরে ফেলছো।’
এছাড়াও চট্টগ্রামের ভারতীয় সহকারী দূতাবাসের সামনেও অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।
মন্তব্য করুন