আতাউর রহমান
প্রকাশ : ২২ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ জুন ২০২৩, ০৯:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পরোয়ানা নিয়ে ঘুরছে ৪১ হাজার আসামি

বছরের পর বছর ঘুরে বেড়াচ্ছে আসামিরা
পরোয়ানা নিয়ে ঘুরছে ৪১ হাজার আসামি

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মতিঝিলে খুন হয়েছিলেন পুলিশ কনস্টেবল বাদল মিয়া। ওই ঘটনায় আদালত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন প্রধান আসামি রিপন নাথ ঘোষকে। পলাতক থাকায় ওই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) জারি করেন আদালত। তবে সবার ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে তিনি বাসের হেলপারি করছিলেন প্রকাশ্যেই। শেষ পর্যন্ত ১০ বছর পর সম্প্রতি র‌্যাব মৃত্যুদণ্ডের ওই আসামিকে গ্রেপ্তার করে।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে পুরান ঢাকায় চাঞ্চল্যকর বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাজন তালুকদার। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা; কিন্তু ১১ বছরেও তামিল হয়নি সেই পরোয়ানা। শুধু তাই নয়, গত বছরের নভেম্বরে ঢাকার সিএমএম আদালত

এলাকা থেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি মাইনুল হাসান শামিম ওরফে সিফাত এবং আবু সিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নেয় তার সহযোগীরা। ওই দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারেও রয়েছে পরোয়ানা; কিন্তু গ্রেপ্তার করা যায়নি গত সাত মাসেও।

শুধু খুনের মামলার আসামি রাজন তালুকদার, জঙ্গি মাইনুল বা সোহেল নয়, রাজধানীর ৫০ থানায় এ ধরনের অন্তত ৪১ হাজার ৩০৪ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) ঝুলছে। এসব আসামিকে গ্রেপ্তারে আদালত থেকে শুরু করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাগিদ দিলেও সাফল্য আসছে না। পরোয়ানা মাথায় নিয়েই পুলিশের ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব আসামি।

পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরোয়ানার এসব আসামির মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, জঙ্গি, ডাকাতি, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদক, চোরাচালান, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতাসহ নানা মামলার আসামি রয়েছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আদালতের দণ্ড থাকার পাশাপাশি জামিনে বেরিয়ে হাজিরা না দেওয়ায় পরোয়ানা জারি রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, সব সময়ই পরোয়ানা তামিলের জন্য থানাগুলোকে বলা হয়। তবে যতদিন পুলিশের কার্যক্রম ও যতদিন বিচার ব্যবস্থা চলবে, ততদিন ওয়ারেন্টও আসবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।

৪১ হাজারের বেশি ওয়ারেন্ট ঝুলে থাকার বিষয়ে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘একবারে কখনোই সব আসামিকে ধরাও যায় না। তবে ধরার যে চেষ্টা, যে প্রচেষ্টা-সেটা অব্যাহত আছে।

ওয়ারেন্ট ঝুলে থাকায় বিচার কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়ে কি না জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু কালবেলাকে বলেন, আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও ঠিকঠাক তা তামিল হয় না। দেখা যায়, বিচার চলছে, আসামি নেই। এতে মামলার বিচার কাজ শুরু করতে অনেক সময়ে বিলম্ব হয়। মামলা জটও তৈরি হয়। একপর্যায়ে আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ চালাতে হয়। এতে অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।

কালবেলার কাছে গত মে মাস পর্যন্ত থাকা তথ্য বলছে, আদালত থেকে রাজধানীর ৫০ থানায় পাঠানো ওয়ারেন্টের মধ্যে জেনারেল রেজিস্ট্রার (জিআর) বা থানায় করা মামলায় ২০ হাজার ৩৪৮টি এবং কোর্ট রেজিস্ট্রার (সিআর) বা আদালতে দায়ের মামলার ২০ হাজার ৯৫৬টি ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে।

যে কারণে ঝুলে আছে হাজার হাজার ওয়ারেন্ট : অভিযোগ রয়েছে, থানার পুলিশের অনেকেই আসামিদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে মাসের পর মাস তাদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেয় না। অনেক ক্ষেত্রে থানা পুলিশ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আদালতের ওয়ারেন্ট তামিলের সুযোগ পায় না তারা। আদালত থেকে পাঠানো ওয়ারেন্ট খুঁজে না পাওয়ার অজুহাতও রয়েছে থানা পুলিশের। আবার বছরের পর বছর ধরে আসামির অবস্থান শনাক্ত করতে না পারায় ওয়ারেন্ট তামিল করা যাচ্ছে না।

ঢাকার অন্তত ছয়টি থানার ওসি ও অপারেশন শাখার পরিদর্শকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, থানাগুলোতে আলাদাভাবে ওয়ারেন্ট তামিল করার অফিসার নেই। একটি থানার দৈনন্দিন কাজ, এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, নতুন মামলার আসামি গ্রেপ্তার, আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতে নিয়ে যাওয়া, মামলার তদন্তে সময় দেওয়া এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মামলায় সাক্ষ্য দিতে দেশের বিভিন্ন আদালতে যেতে হয়। এসব কারণে পুরোনো ওয়ারেন্ট তামিল করতে সময় বের করা কঠিন। এর পরও প্রত্যেক মাসেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ওয়ারেন্ট তামিল বা আসামি গ্রেপ্তার করে পরোয়ানা নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের একটি থানার ওসি বলেন, ওয়ারেন্টে আসামিদের নাম, বাসার নম্বর ও এলাকা থাকে। কিন্তু একটি ওয়ারেন্ট তামিল করতে ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে জানা যায়, যে নামের ব্যক্তিকে খোঁজ করা হচ্ছে, ওই ব্যক্তি বহু বছর আগে বাসা বদল করেছে। নতুন বাসায় ভাড়াটে তথ্য ফরম পূরণ না করায় ওই আসামির অবস্থানও শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

আরেক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ওয়ারেন্টের অনেক আসামি হয়তো বিদেশে পলাতক। এজন্য তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য ওয়ারেন্টগুলো ঝুলে আছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, এখন আর ওয়ারেন্ট হারানোর সুযোগ নেই। কারণ আদালত থেকে পাঠানো সব ওয়ারেন্ট সঙ্গে সঙ্গে ক্রিমিনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএিএস) সার্ভারে যুক্ত করা হচ্ছে। এ সার্ভারে থানাভিত্তিক ওয়ারেন্টের আসামিদের ডাটা রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি যে পাঁচ থানায় ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে : মে মাস পর্যন্ত ঝুলে থাকা ৪১ হাজার ৩৪৮টি ওয়ারেন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ওয়ারেন্ট ঝুলে রয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। গত মে মাস পর্যন্ত ওই থানায় ৫ হাজার ৮৪৯টি ওয়ারেন্ট ঝুলে ছিল। অর্থাৎ আদালতের পরোয়ানা থাকলেও ওই থানায় ওই সংখ্যক আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এর পরই মিরপর থানায় ৩ হাজার ১৬টি, পল্লবী থানায় ২ হাজার ৭১৪টি, যাত্রাবাড়ী থানায় ২ হাজার ২৭৩টি এবং কাফরুল থানায় ১ হাজার ৪২৮টি ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে।

সবচেয়ে কম ওয়ারেন্ট যে পাঁচ থানায় : থানায় জমা পড়া ওয়ারেন্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মে মাস পর্যন্ত বিমানবন্দর থানায় সবচেয়ে কম ৩০টি ওয়ারেন্ট ঝুলে ছিল। এর পর উত্তরা-পূর্ব থানায় ৭৩টি, উত্তরখান থানায় ১৪২টি, ক্যান্টনমেন্ট থানায় ১৪২টি এবং নিউমার্কেট থানায় সর্বনিম্ন ১৯১টি ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে।

পরোয়ানা ইস্যুর চেয়ে নিষ্পত্তি কম : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানাগুলোতে প্রতিমাসে যে পরিমাণ পরোয়ানা ইস্যু হয়, মাসে গড়ে তার মাত্র ২৫ ভাগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। প্রতিমাসেই ইস্যু করা ৭৫ ভাগ ওয়ারেন্ট ঝুলে থাকছে।

ডিএমপির একজন কর্মকর্তা জানান, গত মে মাসে আদালত থেকে ডিএমপির ৫০ থানায় ২ হাজার ৮৯১টি পরোয়ানা আসে। এর মধ্যে মাত্র ৭০৮টি পরোয়ানা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। সে হিসাবে মাত্র ২৪ ভাগ পরোয়ানা নিষ্পত্তি করা গেছে এক মাসে। এভাবেই নিষ্পত্তির চেয়ে প্রতিমাসে পরোয়ানা ইস্যু বেশি হওয়ায় তা ঝুলে যাচ্ছে।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, শুধু আসামি গ্রেপ্তারই নয়, অনেক আসামি মারা গেলে বা কোনো কোনো আসামি আদালত থেকে জামিন এনে তা থানায় জমা দিলেও তা ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তি আকারে দেখানো হয়।

শুধু মে মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই মাসে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ সবচেয়ে বেশি ৭২টি ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তি করেছে। এর মধ্যে জিআর ৬৮টি এবং সিআর ওয়ারেন্ট রয়েছে চারটি। এর পরই পল্লবী থানা ৩৬টি, তেজগাঁও থানা ৩৫টি, বাড্ডা থানা ৩৩টি এবং কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশ ৩০টি ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তি করে।

সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক কালবেলাকে বলেন, পুলিশে আলাদা ওয়ারেন্ট অফিসার নেই। আদালত থেকে থানায় ওয়ারেন্ট গেলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি তার অধীন উপপরিদর্শক (এসআই) ও সহকারী উপপরিদর্শককে (এএসআই) সেই ওয়ারেন্ট তামিলের দায়িত্ব দেন। প্রত্যেক অফিসার একাধিক ওয়ারেন্ট তামিলের দায়িত্বে থাকেন। তারা ওয়ারেন্টের আসামি গ্রেপ্তারে অভিযানেও যান; কিন্তু আসামি তো আর ঠিকানা মতো বসে থাকে না। এ জন্য অবস্থান শনাক্তে সময় লাগে; কিন্তু প্রতিদিনই আদালত থেকে নতুন ওয়ারেন্ট আসে। এ জন্য ওয়ারেন্টগুলো ঝুলে যায়। তবে অন্যান্য কাজের সঙ্গে এগুলো নিষ্পত্তিতে পুলিশের আন্তরিকতার অভাব থাকে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাতের মধ্যে ৫ অঞ্চলে ঝড়ের আশঙ্কা, সতর্ক সংকেত

গাজীপুরে বজ্রপাতে গৃহবধূর মৃত্যু

জাল ভোট পড়লেই কেন্দ্র বন্ধ হবে : ইসি আহসান হাবিব

গাজায় ২৪ ঘণ্টায় নিহত ৮৩ ফিলিস্তিনি

বন্ধুকে বাড়িতে ডেকে হত্যা, সৈনিক লীগ নেতা গ্রেপ্তার

ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে বাংলাদেশের নারীরা

বিজ্ঞপ্তির চাহিদা অনুযায়ী গম্ভীর কি আদৌ যোগ্য?

পেনশন স্কিমে নিবন্ধন না করলে আশ্রয়ণের ঘর বাতিলের হুমকি

গারো পাহাড়ে সাম্মাম চাষে সফল আনোয়ার

২০৫০ সালের মধ্যে মানুষের আয়ু বাড়বে ৫ বছর : গবেষণা

১০

দেশে ১১ জনের করোনা শনাক্ত, একজনের মৃত্যু

১১

২৬ কোম্পানির বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা

১২

চাকরির সুযোগ দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা

১৩

ঢাবিতে ১৩তম কেমিস্ট্রি অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত

১৪

বাইক আরোহীদের হেলমেট নিশ্চিতে মাঠে নেমেছে চাঁদপুর জেলা পুলিশ

১৫

সন্ধ্যার মধ্যে তীব্র ঝড় হতে পারে যেসব জেলায়

১৬

কলার কাঁদি নিয়ে ঝগড়ায় ভাইয়ের হাতে ভাই খুন

১৭

নির্বাচনসংক্রান্ত সেবা মিলবে ৯৯৯-এ

১৮

এক জালে ধরা পড়ল ১৬ লাখ টাকার ইলিশ

১৯

৩৪ জনকে নিয়োগ দেবে বিআরটিসি, আবেদন অনলাইনে

২০
X