তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। সরকারি কর্মচারী হিসেবে রোগীদের দেখভাল এবং সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেওয়া তার দায়িত্ব। কিন্তু হাঁটছেন উল্টোপথে। স্ত্রীর মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করেছেন বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানেই দেখছেন রোগী। সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীদের প্রলোভনে ফেলে পাঠান নিজেদের হাসপাতালে। যোগ্য চিকিৎসক এবং নার্স না থাকলেও সেখানে চলে জটিল রোগের অস্ত্রোপচার। ফলে মাঝেমধ্যেই ঘটছে রোগী মৃত্যুর ঘটনা। এমনকি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা অন্য হাসপাতালগুলোতেও ছড়ি ঘোরান তিনি। কমিশন বাণিজ্য এবং মতের অমিল হলেই বন্ধ করে দেন সেসব হাসপাতাল। নারী সহকর্মীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা, দুর্নীতি, প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অপরাধ করেও পদে বহাল থেকে লুটেপুটে খাচ্ছেন উপজেলার স্বাস্থ্য খাতের টাকা।
রাজধানীর অদূরে দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্র ভৈরব। দেশের আর দশটা উপজেলা শহরের চেয়ে আয়তনে বড় এই শহরটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শহরটিতে গড়ে উঠেছে ২৩টি হাসপাতাল। আর এসব হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার হাতে। এমনকি নিজের স্ত্রীর মালিকানায়ও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতাল নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন হাসপাতালের মালিকরা অভিযোগ করেছেন, ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহম্মেদ স্বাস্থ্যসেবাকে ঘিরে একটি বাণিজ্যিক মাফিয়া সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল। বুলবুল আহমেদের এই সিন্ডিকেটের সহযোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ফরহাদ হোসেন। তিনিও স্ত্রীর নামে নিবন্ধন নিয়ে গড়ে তুলেছেন আরেকটি হাসপাতাল, যার নাম উইমেন্স হেলথ কেয়ার।
ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে রোগী নেই। ভুক্তভোগীরা বলছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তাররা অফিসে থাকেন না। তারা বেসরকারি হাসপাতালেই সময় দেন। এ ছাড়া নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হয় তাদের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা এক গৃহিণীর স্বামী আবু ইসাহাক দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘গরিব মানুষ আমরা। চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে এলে টেস্ট করতে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। পরে আবার ডাক্তার দেখাতে এলে তারা বলেন, স্যার এখানে নেই। মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে যান।’
কালবেলার হাতে আসা একটি ফোন কল রেকর্ডে শোনা যায়, ভৈরবের রামনগরের এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে চাইলে অন্য প্রান্তের চিকিৎসক তাকে ডা. বুলবুলের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলেন।
ভৈরবের লক্ষ্মীপুর রোডে অবস্থিত মা ও শিশু হাসপাতাল। আর ভৈরব-কিশোরগঞ্জ রোডের হাজী আসমত কলেজ এলাকার উল্লাপাড়ায় অবস্থিত উইমেন্স হেলথ কেয়ার। উপজেলা হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল দুটিতে পরপর পাঁচ দিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অসংখ্য রোগীর ভিড়। এমনকি তাদের সবাইকে বসতে দেওয়ার মতো জায়গাও নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালকেন্দ্রিক বাণিজ্য সিন্ডিকেটের প্রধান ডা. বুলবুল আহম্মেদ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনি বসেন কালেভদ্রে। রোগী দেখেন নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীদের নিজের হাসপাতালে বাগিয়ে নেন। এমনকি নারী সহকর্মীও তার কাছে নিরাপদ নয়। শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে এক নারী সহকারী সার্জনকে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পদাবনতিও ঘটেছিল তার। তখন তাকে ভৈরব থেকে কুমিল্লায় আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে বদলি করা হয়। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে মাত্র ১৪ দিন পরই ভৈরবে স্বপদে ফিরে আসেন। সেই থেকে আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন এই চিকিৎসক। তার সঙ্গে মতের অমিল হলে ক্ষমতাবলে বন্ধ করে দেন অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক। ভৈরব উপজেলার ২৩টি বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তার কাছে জিম্মি। অনেকে গোপনে তাকে ম্যানেজ করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখেন। যারা তাকে ম্যানেজ করতে পারেন না তাদের ওপর নেমে আসে খড়্গ।
জানা যায়, সম্প্রতি নিউ টাউন রোডের আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালের (প্রাঃ) মালিকদের পারিবারিক দ্বন্দ্বের খবর পেয়ে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেন। আরেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ জেনারেল হাসপাতাল থেকে রেফার করা এক রোগী ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান। ওই ঘটনার পর গ্রামীণ জেনালের হাসপাতালে হামলার ঘটনা ঘটে। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। সেই কমিটির প্রধান ছিলেন ডা. বুলবুল আহম্মেদ। তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য মেডিকেল অফিসার ডা. ফরহাদ হোসেন। দুজনই ভৈরবে দুটি হাসপাতালের মালিক। কমিশন বাণিজ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলছিল গ্রামীণ জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে। তদন্ত কমিটির দায়িত্ব নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটান এই দুই চিকিৎসক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) স্বাক্ষরিত এক পত্রে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়। কিন্তু বুলবুল আহম্মেদ নিজ ক্ষমতাবলে হাসপাতালটি সিলগালা করে দেন। এতে ফার্মেসি ও ডায়াগনস্টিক সেবাও বন্ধ হয়ে যায়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, হাসপাতালটির সেবার মান ভালো হওয়ায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই চিকিৎসকের নানা প্রলোভন সত্ত্বেও রোগীরা ওই হাসপাতালমুখী হচ্ছিলেন। এতেই হিংসার বশবর্তী হয়ে হাসপাতাল বন্ধ করে দেন তারা।
গ্রামীণ জেনারেল হাসপাতালের মালিক মো. বদিউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘ভৈরবের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ডা. বুলবুল আহম্মেদের ইচ্ছার বাইরে পরিচালনা করা অসম্ভব। তার সঙ্গে মতের অমিল হলে বিভিন্ন বাহানায় হাসপাতাল বন্ধ করে দেন। আমার প্রতিষ্ঠানও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন।’
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, ডা. বুলবুল আহম্মেদের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ জন রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নার্সের ভুল ইনজেকশনে এক নবজাতক মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী তার নিজ বাড়িতেই একটি ফুটফুটে ছেলেসন্তান প্রসব করেন। জন্মের পর থেকে নবজাতকের কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। পরে শিশুটিকে বিকেলে মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত এক নার্স অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেন এবং একটি ইনজেকশন পুশ করেন। ইনজেকশন পুশ করার আধা ঘণ্টার মধ্যেই শিশুটির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। ফলে শিশুটি মারা যায়। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ইনজেকশন দেওয়ার ৩ ঘণ্টা পর মারা যায়।
এর আগে ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রানু বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, করসন ও লেসিস নামের দুটি ইনজেকশন দেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্য শরীরে কাঁপুনি দিয়ে তিনি মারা যান। এরপর তড়িঘড়ি করে ওই রোগীর মাকে সঙ্গে দিয়ে কোনোরকম কাগজপত্র বা ছাড়পত্র ছাড়াই অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রোগীর অভিভাবকরা খবর পেয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার নীলকুঠি এলাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি আটক করেন এবং দেখতে পান মৃত রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। পরে তারা নিহত রানু বেগমের লাশসহ হাসপাতালে ফিরে স্থানীয় সাংবাদিকদের ঘটনা অবহিত করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই রোগীকে যিনি ইনজেকশন দিয়েছিলেন, সেই নার্স মোমেনা বেগমের কোনোরকম নার্সিং ট্রেনিং সার্টিফিকেট নেই। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন বলে জানান।
২০১৫ সালের অক্টোবরে মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় হেদায়েত উল্লাহ নামে এক পাদুকা শ্রমিকের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে।
এরপরও তার প্রতিষ্ঠান কখনো বন্ধ করা হয়নি। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত ডা. বুলবুলের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছিলেন। স্থানীয় সাংবাদিক এম আর রুবেল তার অপকর্ম নিয়ে কথা বলায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা ঠুকে দেন। কারাভোগের পর সম্প্রতি ওই মামলায় তকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত।
বুলবুলের নানা অপকর্মের বিষয়ে গত বছর ৭ জুন ভৈরবের কাদের সোহেল নামে এক ব্যক্তি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর একটি অভিযোগপত্র জমা দেন। সেখানে বলা হয়, ‘সরকারি হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে রোগীদের, বুলবুল আহম্মেদের নিজের হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিনিসহ অন্য চিকিৎসকরা সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ডিউটিরত অবস্থায় নিজেদের বেসরকারি হাসপাতালে রোগী দেখেন। ২০২২ সালের ৬ জুন সকাল ৮টা ৪০ থেকে ৯টা পর্যন্ত এবং দুপুর ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত সরেজমিন হাসপাতাল ঘুরে ইমার্জেন্সি বিভাগ ছাড়া কোথাও চিকিৎসক ছিলেন না। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ অন্য চিকিৎসকদের রুম তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কিশোরগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ভিডিওসহ অভিযোগ করা হয়।’
এসব বিষয়ে কথা বলতে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহম্মেদের মোবাইল নম্বরে কল করা হয়। তিনি ফোন ধরার পর সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত হাসপাতাল পরিচালনাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জানানো হলে তিনি ‘ব্যস্ত আছেন’ জানিয়ে পরে ফোন করতে বলেন। এরপর বারবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
মেডিকেল অফিসার ডা. ফরহাদ হোসেনের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
যোগাযোগ করা হলে কিশোরগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘একজন সরকারি চিকিৎসক চাকরিবিধি অনুযায়ী হাসপাতালে উপস্থিত না থাকলে কিংবা অন্য কোনো অনিয়মে জড়িয়ে পড়লে কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বেসরকারি হাসপাতালে অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু ভৈরব নয়, কিশোরগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা কর হয়। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশের কোনো সুযোগ নেই।’
ডা. বুলবুল আহম্মেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে তিনি তো বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কেউ অভিযোগ জানালে তদন্ত করে ব্যবস্থা করা হবে। সেখান থেকে অধিদপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন এলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’