শাহ আলম খান
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ০২:১৮ এএম
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক সংঘাতের প্রভাব অর্থনীতিতেও

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনা-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতি রয়েছে টালমাটাল অবস্থায়। এতে রিজার্ভে টান, আমদানি কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ আর ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিতে অনেকদিন ধরেই অভ্যন্তরীণ

ব্যবসা-বাণিজ্যে একটা মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষ কম খাচ্ছে, কম ব্যবহার করছে, যা সরকারের রাজস্ব আয়কে উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন সেই টালমাটাল অর্থনীতিতে আরেক আতঙ্ক দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সেটি হলো জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে সমঝোতার প্রশ্নে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, যা এরই মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সৃষ্টি হওয়া এই উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় গড়িয়েছে এবং টানা তিন বছর আট মাস পর দেশ ফের হরতালের কবলে পড়েছে। দেশীয় সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার শেষ পরিণতি হলো এই হরতাল, যা জ্বালাও-পোড়াও, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, যান চলাচল ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং ভাঙচুর ও জানমালের ক্ষতি দিয়ে শেষ হয়। এতে রাজনৈতিক ফায়দা কতটুকু হাসিল হয়, সেটি প্রশ্ন তোলার অবতারণা থাকলেও তার মূল্য যে ব্যবসায়ী ও সাধারণের আয় রোজগারের ওপর সরাসরি এসে পড়ে, তা নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেন না।

এদিকে চলমান এই রাজনৈতিক সংঘাত ঘিরে ডাকা হরতাল এখন আরও অগ্রসর হয়ে দেশব্যাপী তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচিতে গড়াচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, এই সময় সারা দেশে রেল, নৌ ও সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ থাকবে। এতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক পণ্যের আনা-নেওয়া এবং

আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে দেশব্যাপী সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়বে, যার প্রভাব গিয়ে ঠেকবে ভোক্তার চাহিদাকৃত পণ্যের ক্রয়মূল্যের ওপর। অন্যদিকে ওই সময় রাজপথ উত্তপ্ত থাকবে। এর প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে। দোকানপাট খোলা না থাকলে এবং খেটে খাওয়া মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেলে অস্বাভাবিক হয়ে পড়বে জীবনযাত্রা। এতে সাধারণ মানুষও অসহিষ্ণু হয়ে উঠলে সার্বিকভাবে অর্থনীতি দীর্ঘ সংকটের মুখে ধাবিত হবে।

এ ধরনের অনভিপ্রেত পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে চলমান এই উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিকে কোথায় নিয়ে যাবে সে অনিশ্চয়তায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তারা সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে তথা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে অবিলম্বে রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ করে সমঝোতার উপায় খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন।

এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল হুদা চপল দৈনিক কালবেলাকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনীতি ঠিক না থাকলে কিছুই ঠিক থাকবে না। নিরাপত্তা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে যাচ্ছে। যখন নিরাপত্তা থাকবে না, তখন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না। তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় চাপে থাকা অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়বে। ফলে আগামীতেও যারা আসবেন, এই অর্থনীতিকে তাদেরই টেনে নিতে হবে। আমরা আশা করব, রাজনীতিবিদরা সে উপলব্ধটি করতে সক্ষম হবেন এবং নিশ্চয়ই তারা একটা সমঝোতায় পৌঁছবেন কিংবা রাজনৈতিক

দাবি-দাওয়া আদায়ের ইস্যুতে অর্থনীতি আর মানুষকে হাতিয়ার বানানোর অস্ত্র থেকে বিরত থাকবেন। রাজনৈতিক পক্ষগুলো শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে।

বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলা বলেন, রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও আস্থার জায়গা না থাকলে এবং

আলোচনা-সমঝোতার সুযোগ ব্যর্থ হলেই এ ধরনের পরিস্থিতির অবতারণা হয়। রাজনৈতিক চর্চা যে মূল্যবোধের ভিত্তিতে করতে হয়, সেটি যদি রাজনীতিবিদরা করতে না পারেন, তাহলে তো আর কিছু বলার থাকে না তবে দেশকে, অর্থনীতিকে এবং মানুষকে জিম্মি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অধিকার রাজনীতিবিদদের নেই। এই অধিকার কেউ তাদের দেয়নি। আবার এটাও বুঝতে হবে, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই। একটা গোষ্ঠী পাওয়ারে থাকবে, আরেকটা বিরোধী অবস্থানে থাকবে। সবার রাজনৈতিক চর্চাই হবে দেশের স্বার্থে কাজ করা। এটা তারা মাঝে মাঝেই ভুলে যান বলে দেশকে কিছুদিন পরপর একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। তাই বলব, কোনো অবস্থাতেই সংঘাত যাতে দীর্ঘ না হয়। সংঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান হোক; কিন্তু দুঃখজনক হলো, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা সেই কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্জন করতে পারলাম না।

এক প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এমনিতেই দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতি খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এখন রাজনীতির নামে যা শুরু হয়েছে, তা চলতে থাকলে এই অর্থনীতি একেবারে রসাতলে যাবে। অর্থনীতি খারাপ হলে সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। হরতাল-অবরোধ ও সংঘাতের কারণে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হলে সেখানে বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা দেশে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। সব মিলে সমঝোতার রাস্তা তৈরি না হলে এবং সেখানে সরকারকেই উদ্যোগী ভূমিকায় দেখা না গেলে অর্থনীতিকে চরম মাশুল দিতে হবে, যার থেকে উত্তরণে দেশকে দীর্ঘ সময় পিছিয়ে যেতে হবে।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান কালবেলাকে বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে দেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে কমে ২০ বিলিয়নে নেমেছে। দ্রব্যমূল্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। তৈরি পোশাক খাতের অবস্থা আরও খারাপ। একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে বায়াররা তাদের ক্রয় আদেশ কমিয়ে দিচ্ছে।

এ অবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়বে, দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দেবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সময়মতো পণ্যের জাহাজীকরণ বাধাগ্রস্ত হবে। এতে রপ্তানির লিড টাইম বেড়ে যাবে। এ সুযোগে বায়াররা তাদের ক্রয়াদেশ আরও কমিয়ে দেবে, আগের দেওয়া ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে দেরি করবে। এ বিষয়টি সবাইকে অর্থাৎ সরকারে যারা আছে, বিরোধী দলে যারা আছে এবং শ্রমিক সংগঠন সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। কেননা, রাজনৈতিক এসব কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো অসন্তোষ তৈরির চেষ্টা করছে। ভাঙচুর করার চেষ্টা করছে। এর ফলে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

১০ বছর আগে ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণায় বেরিয়ে আসে, একদিনের হরতালে আর্থিক ক্ষতি, ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে অর্থনীতির আকার ৪ গুণ বেড়েছে। ফলে এ সময়ের

হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ক্ষতিও সে হারে বাড়বে।

এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবীর বলেন, ২০২৩ সালের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় এক দিনের

হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের আর্থিক ক্ষতি অন্তত ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ছাড়াবে।

জানা গেছে, এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচন ঘিরেও রাজনীতি উত্তপ্ত হয়। তখন জ্বালাও-পোড়াও দেখা যায় বিএনপি-জামায়াতের। সে সময় রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ চেইন বিচ্যুত হয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। খেটে খাওয়া মানুষের নিত্যদিনের আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এখন দেশ ফের সেদিকেই এগোচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দায়িত্ব নিয়েই হুঁশিয়ারি দিলেন সারোয়ার আলম

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইআরআই’র প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

পাকিস্তানের সঙ্গে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি অনুমোদন

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির রোডম্যাপ এ সপ্তাহে আর ঘোষণা হচ্ছে না

ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই, হতাশ জেলেরা

গাজীপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ

জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করলেন তামিম

পেছনের পকেটে মানিব্যাগ রাখেন? অজান্তেই ডেকে আনছেন যে অসুখ

দিনাজপুরে পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন নিয়ে কর্মশালা

মাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ধরা পড়লেন চীনা গুপ্তচর

১০

নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও ৬ বিভাগে ভারী বৃষ্টির শঙ্কা

১১

সাদাপাথর লুট, এবার তদন্তে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ

১২

মালয়েশিয়া যাচ্ছেন নাহিদ ইসলাম

১৩

ছাত্র হত্যা মামলার আসামি ইউএনও রাহুল চন্দ ওএসডি 

১৪

ইবনে সিনায় চাকরি, বেতন ছাড়া পাবেন আরও বিভিন্ন সুবিধা

১৫

চট্টগ্রামের চকবাজারে ট্রান্সকম ডিজিটালের নতুন শোরুম উদ্বোধন

১৬

পুরুষদের নয়, পিতৃতন্ত্রকে অপছন্দ করি : বাঁধন

১৭

অনুভূতিহীন তথাকথিত কবি-শিল্পীরা ১৫ আগস্ট শোক জানিয়েছে : রিজভী

১৮

সুখবর পেলেন নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়া ক্রিকেটার

১৯

অডিশনের সময়ে বিদ্যা আমাকে গালাগাল করেছিল : বিধু বিনোদ 

২০
X