৩৭ বছর পর দেশে আবারও জ্বালানি তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। এবারও সিলেটে মিলেছে এ খনি। তবে এখনো মজুত তেলের পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর পরও নতুন খনি পাওয়ায় আমদানিনির্ভরতা কিছুটা কমবে মনে করছেন জ্বালানি কর্মকর্তারা। এর আগে ১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম তেলের খনি পাওয়া যায়। তখন দৈনিক ৫০০ ব্যারেল করে উত্তোলন করা হতো। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ১০ নম্বর অনুসন্ধান কূপে এ তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। গতকাল রোববার দুপুরে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘বিজয়ের মাসে এটা আমাদের জন্য একটি সুখবর। সিলেট গ্যাস ক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপটির প্রথম স্তরে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্যাস ও তেলের স্তর ভিন্ন ভিন্ন। এখানে ড্রিল করার সঙ্গে সঙ্গেই তেল উঠছে।’ তিনি আরও বলেন, এ কূপে গ্যাসের মজুতের পরিমাণ ৪৩ দশমিক ১০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে আশা প্রকাশ করছি।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নতুন খনিতে তেলের মজুত ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ব্যারেল। আমদানি করা অপরিশোধিত তেলের মূল্য (প্রতি লিটার ৫৬ টাকা) হিসাবে ৭ হাজার কোটি টাকা। গ্যাস অনুসন্ধানের সময় ১ হাজার ৩৯৭ থেকে ১ হাজার ৪৪৫ মিটার গভীরতায় একটি জোন পাওয়া যায়, যেখানে গত ৮ ডিসেম্বর টেস্ট করে তেলের উপস্থিতি জানা যায়। যার প্রাথমিকভাবে এপিআই গ্রাভিটি ২৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি। সেলফ প্রেশারে (নিজস্ব চাপ) ঘণ্টায় ৩৫ ব্যারেল তেলের প্রবাহ পাওয়া গেছে। পুরো পরীক্ষা সম্পন্ন হলে তেলের মজুতের পরিমাণ জানা যাবে। এজন্য আরও কয়েক মাস সময় লাগবে।
বিপিসির তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়। এতে বছরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়।
সিলেট ১০ নম্বর কূপে ২ হাজার ৫৭৬ মিটার গভীরতায় খনন সম্পন্ন করা হয়েছে। এ কূপে চারটি স্তরে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ২ হাজার ৫৪০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ মিটার গভীরের স্তরটি টেস্ট করে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রবাহ পাওয়া যায় এবং ফ্লোয়িং প্রেসার ৩ হাজার ২৫০ পিএসআই। মজুতের পরিমাণ ৪৩ থেকে ১০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ২ হাজার ৪৬০ থেকে ২ হাজার ৪৭৫ মিটারে আরও একটি গ্যাস স্তর পাওয়া যায়, এখানে টেস্ট করলে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২ হাজার ২৯০ থেকে ২ হাজার ৩১০ মিটারে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ২ হাজার ৫৪০ এবং ২ হাজার ৪৬০ মিটার গভীরতায় একযোগে উৎপাদন করা হলে প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর এ গ্যাসের উৎপাদন চলবে। যদি দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে উৎপাদন করা হয়, তাহলে ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে উৎপাদন করা যাবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে নসরুল হামিদ বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কাজ অব্যাহত থাকবে। মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিডিং রাউন্ডে যাবে। তিনি বলেন, ২০২২ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত কয়েকটি কূপে মোট ১০৫ এমএমসিএফডি গ্যাস পাওয়া গেছে। ৪৬টি কূপের সন্ধান করা হবে, যা থেকে ৬১৮ এমএমসিএফডি গ্যাস পাওয়ার আশা করা যাচ্ছে।
এর আগে গত বছর বাংলাদেশ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এক গবেষণায় উল্লেখ করেছিলেন, পরিত্যক্ত হরিপুর তেলক্ষেত্রে আরও ৩০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রয়েছে, যার বাজারমূল্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রের ৭ নম্বর কূপে ৩ হাজার ২৬০ থেকে ৩ হাজার ২৭০ মিটার গভীরে তেলের স্তর রয়েছে, যেখানে ৯০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাস আছে কি না, সে গবেষণা কার্যক্রমটি প্রধানমন্ত্রীর উচ্চশিক্ষা গবেষণা তহবিলের অর্থায়নে পরিচালনা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এ গবেষণা শেষ হয় ২০২১ সালে।
এরও আগে ২০১২ সালে পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর দেশের পুরোনো দুটি গ্যাসক্ষেত্র সিলেটের কৈলাসটিলা ও হরিপুরে তেলের মজুতের সন্ধান পেয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। ওই সময় জানানো হয়, এ দুটি জায়গায় তেল মজুতের পরিমাণ ১৩৭ মিলিয়ন ব্যারেল হলেও উত্তোলন করা সম্ভব হবে ৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল। সন্ধান পাওয়া তেলের মধ্যে ১০৯ মিলিয়ন ব্যারেল রয়েছে সিলেটের কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে। আর বাকি ২৮ মিলিয়ন ব্যারেল রয়েছে হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রে। এ দুটি ক্ষেত্র থেকে সব মিলে ৫৫ মিলিয়ন ব্যারেলের মতো তেল উত্তোলন করা যাবে। পরে বিষয়টি নিয়ে সরকার আর এগোয়নি।
গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে সিলেটের ১০ নম্বর কূপের খনন কাজ। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর এ কাজে ঠিকাদার হিসেবে চীনের সিনোপ্যাক ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম সার্ভিস করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।