নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে নৌকার প্রার্থী তানভীর হাসান ছোট মনিরের বিরুদ্ধে। বাস্তবে ছোট মনির এবং তার স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ থাকলেও তা উল্লেখ করা হয়নি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায়, যা ২০২৩ নির্বাচনী ম্যানুয়াল মতে, ধারা-১৮১, দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এ উল্লিখিত অপরাধ।
হলফনামায় তথ্য গোপন করার পরও তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ছোট মনিরের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করায় প্রশ্ন উঠেছে রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বচ্ছতা নিয়েও। ফলে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অন্য সব প্রার্থীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ নিয়ে প্রার্থীরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। এসব অভিযোগের কপি, স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পত্তির কাগজপত্র এবং হলফনামার কপি রয়েছে কালবেলার হাতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছোট মনিরের নামে ‘দি টাঙ্গাইল মডেল ফিলিং স্টেশন’ নামে একটি পাম্প রয়েছে। তবে তা তিনি নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করেননি। এই ফিলিং স্টেশনে ছোট মনিরের ৩ লাখ শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া ফিলিং স্টেশনের প্রকল্প ব্যয় ২২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা প্রদর্শন করে ১৪ কোটি ২১ লাখ ৭১ হাজার ৫১৭ টাকা যৌথভাবে ব্যাংক লোন দেখিয়েছেন তিনি। সে হিসাবে বাকি ৮ কোটি টাকায় তার অংশের ৪ কোটি টাকার আয়ের কোনো উৎস দেখাননি। আবার ট্যাক্স পেপারে নিজের ব্যবহৃত দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলেও উল্লেখ নেই হলফনামায়। বিআরটিএ সূত্রে
জানা গেছে, ছোট মনিরের ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮- ৫১৬৫ ও ঢাকা মেট্রো ঘ-২১-৩৩০৪।
স্ত্রীর সব সম্পদ হলফনামায় উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ছোট মনির তা করেননি। অনুসন্ধানে ছোট মনিরের স্ত্রীর নামে মাদারীপুরে ‘ঐশি এগ্রো’ নামে একটি ফার্মের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মাদারীপুর সদরের মৌলভী আসমত আলী খান সড়কের হরি কুমারিয়া এলাকায় ছোট মনিরের স্ত্রীর নামে ৫৫৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ জমির ওপর এই এগ্রো ফার্ম। কিন্তু তিনি সেটি হলফনামায় উল্লেখ করেননি। এ ছাড়া এই জমিটি ১/১ খাস খতিয়ান। এই জমি নিজের নামে দলিল করে নেওয়া যায় না। ছোট মনিরের বাবা আলহাজ মো. আব্দুল গফুর অ্যাডভোকেটের নামে এসএ ৩, বিআরএস ১/১ নং খতিয়ানে ২১৯ শতাংশ জমি রয়েছে। সরকারি নিয়মানুযায়ী, বিআরএস ১/১ এর জমি দলিল করে নেওয়া না গেলেও ছোট মনির তার প্রভাব খাটিয়ে এটি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ছোট মনিরের বড় ভাই মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়ার (বড় মনির) নামে ১৩টি দলিলে ৪৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির সব কাগজপত্র রয়েছে কালবেলার হাতে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তানভীর হাসান ছোট মনির কালবেলাকে বলেন, ‘আপনারে কি দায়িত্ব দিছে? আমার অভিযোগ নির্বাচন অফিস দেখবে। আমি যদি হলফনামায় তথ্য গোপন করে থাকি, সেটা জিজ্ঞেস করার আপনি কেডা? আপনি কে, হু আর ইউ? আপনারে কি দায়িত্ব দিছে সরকার এটা দেখার জন্য। এরকম অভিযোগ নির্বাচন অফিসে আরও পাঁচশজন লোকের বিরুদ্ধে আছে। তাদের ফোন দেন গা।’
তিনি আরও বলেন, ‘অযথা এইসব বাচ্চা পোলাপানের মতো এগুলা করা ঠিক না। কারও নামে অভিযোগ উঠতেই পারে, সেটা নির্বাচন অফিস দেখবে। ১৫ তারিখের পরে দেইখেন নির্বাচন অফিস কী সিদ্ধান্ত নেয়।’ আপনি হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি তো আপনাকে চিনি না। আপনাকে কী বক্তব্য দেব। হু আর ইউ?’ এরপর ফের সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘আমি কি আপনাকে চিনি? আপনাকে বলব?’ এরপর একাধিকবার এই বিষয়ে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য জানতে চাইলেও তিনি কোনো সদুত্তর দেননি। একপর্যায়ে ফোন কেটে দেন।
পাঁচ বছরে যা বেড়েছে, যা কমেছে হলফনামায় ছোট মনির তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সাক্ষরজ্ঞান উল্লেখ করেছেন। পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন বেসরকারি ঠিকাদার। হলফনামা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবসা থেকে ছোট মনিরের বার্ষিক আয় ছিল ৪২ লাখ ৫৯ হাজার ৭৩৪ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এসে সেটা কমে হয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৬০৪ টাকা। তবে ছোট মনিরের নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে মৎস্য খাতে। মৎস্য খাত থেকে বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ৩৯ লাখ ১৫ হাজার ৯০৫ টাকা; ব্যবসা থেকে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৮৫ টাকা এবং ব্যাংক সুদ থেকে ৪৯ হাজার ২৭৫ টাকা। স্বামী ও স্ত্রীর যৌথ নামে ব্যাংকে ৪৭ লাখ ৯৯ হাজার ৭৬৭ টাকা রয়েছে। নিজ নামেও টাকার পরিমাণ বেড়েছে তার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার নগদ টাকা ছিল ২ লাখ। এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এসে তার হাতে নগদ অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে ৮ লাখ এবং যৌথভাবে (নিজ ও স্ত্রীর নামে) রয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৯ টাকা।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় ছোট মনিরের স্বর্ণের পরিমাণ ৪০ ভরি উল্লেখ থাকলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কয়েকগুণ বেড়েছে। বিয়ের সময় উপহার হিসেবে পাওয়া নিজ নামে স্বর্ণ রয়েছে ১৫০ ভরি এবং স্বামী-স্ত্রীর নামে আরও ২০০ ভরি। ছোট মনিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় ৭টি মামলা ছিল। সবকটিতেই তিনি খালাস পেয়েছেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণও বেড়েছে ছোট মনিরের। ২০১৮ সালে নিজ নামে কোনো জমি ছিল না তার। এখন তার গোপালপুর মৌজায় ৯৯ শতাংশ জমি রয়েছে, যার মূল্য ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর নামে ২ হাজার ২৯০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য ৪৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তবে সেটা কোথায়, তার ঠিকানা দেওয়া হয়নি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ছোট মনির ঋণ হিসেবে দেখিয়েছেন জনতা ব্যাংক থেকে ১৪ কোটি ২১ লাখ ৭১ হাজার ৫১৭ টাকা (যৌথ)। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তিনি কোনো ঋণের তথ্য দেননি।