শাহনেওয়াজ খান সুমন
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২৩, ১১:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মশক নিধনকর্মীদের দেখা মেলা ভার

ব্যর্থ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের লোগো
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের লোগো

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকার ডোবা-নালাগুলোতে যেন মশার চাষ চলছে। এলাকার নিচু সড়ক ও জমি, ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পলিথিন, বোতল, ডাবের খোসা, টায়ারসহ নানা জায়গায় জমে আছে পানি। প্রজনন সহায়ক এসব জায়গা থেকে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে এডিস মশার। স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। প্রায় প্রতি বাড়িতেই কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন। আতঙ্কে রয়েছেন সবাই। তবে এ অবস্থায়ও মশা নিধনে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। মশকনিধন কর্মীদেরও খুব একটা দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে এলেও অলিগলিতে ওষুধ না দিয়েই চলে যান তারা।

শুধু ধলপুর নয়, দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, দনিয়া ও কাজলাসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ও রাজত্বের চিত্র দেখা গেছে। সবখানেই যেন ডেঙ্গু আতঙ্ক। দক্ষিণ সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বসবাসের জন্য দয়াগঞ্জ ও ধলপুরে নির্মিত ১০ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে বিশাল জায়গাজুড়ে বৃষ্টির পানি আটকে থাকছে। এ পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তার হওয়ার শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন এলাকাবাসী।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সারা বছরই মশা মারতে ঢাকঢোল পিটিয়ে নানা আয়োজন করে। তবুও এডিস ও কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরবাসীকে। প্রতিবছর প্রাণ হারান শত শত মানুষ। এমন পরিস্থিতির জন্য সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দায়ী করলেও কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, মশা নিধনে মূল কাজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে লোক দেখানো কর্মসূচিতে ব্যস্ত সিটি করপোরেশন। কাজের ফল আসছে কি না, সে বিষয়েও কোনো তদারকি নেই। যে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে মশা। এ নিয়ে গবেষণারও ঘাটতি রয়েছে। ফলে দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু।

ধলপুরের বাদল সর্দার রোডের বাসিন্দা জিয়াউল ইসলাম বলেন, এলাকায় অনেক মশা। দিনে-রাতে সবসময় মশা কামড়ায়। মাঝে মাঝে সিটি করপোরেশন থেকে এসে ওষুধ দিয়ে যায়। এদিকে সব সময় পানি থাকে। বৃষ্টি হলে পানি বেড়ে যায়। ময়লা-আবর্জনা আর পানি জমে থাকার জন্য মশাও বেশি।

মশার ওষুধ দেওয়া হয় কি না, জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পর মাঝে মধ্যে ওষুধ দেওয়া হয়। তবে কোনো উন্নতি দেখি না। যে ওষুধ দেওয়া হয়, সেটা মনে হয় কাজ করে না। ভালো ওষুধ দিতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিদিন দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মশা মারার ওষুধ ছিটানোর কথা। প্রতিটি ওয়ার্ডে এ কাজ করবেন ছয়জন মশককর্মী। তাদের কাজ তদারকিতে থাকবেন একজন সুপারইভাজর।

কাজলা এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬৩নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। স্থানীয় কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম খান বলেন, এখানে মানুষের বাড়ি আছে, তার পাশেই জমি আছে। জমির মধ্যে পানি জমে থাকে। সেখানে এডিস মশার অসংখ্য লার্ভা। জনবল সংকটের কারণে পুরো এলাকায় ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, মানুষ সচেতন না, বাড়ির আশপাশও পরিষ্কার রাখে না। ফুলের টব, ভাঙা বালতি, টায়ার, খানাখন্দে পানি জমে থাকে। এ ছাড়া কাজলা ডাম্পিং এলাকা হওয়ায় ময়লা পরিষ্কার করেও কুলাতে পারি না। তাও আপ্রাণ চেষ্টা করছি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত শীতে কিউলেক্স মশার প্রকোপ কমে আসার পর মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ধীরগতি দেখা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মতভাবে মশার লার্ভা ধ্বংস করা হয়নি। সাধারণত এপ্রিল মাসের শেষে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। সেই সময় ডেঙ্গুর মশার লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও তা ঠিকভাবে পালন করেনি দুই সিটির মশকনিধন বিভাগ। ধোঁয়া দিয়ে মশা মারার পদ্ধতি ভুল বলে এলেও এবারও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সেই একই নিয়মে মশার হটস্পট ধ্বংসের কাজ চলছে। এতে মশা মরা তো দূরের কথা, উল্টো অর্থ নষ্ট হচ্ছে।

দেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। পরের বছর মশা নিয়ন্ত্রণে ঠিক পথেই ছিল দুই সিটি করপোরেশন। সেসময় ওষুধ বদলে ম্যালাথিয়নের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় ডেল্টামেথ্রিন। অন্যদিকে লার্ভা ধ্বংসের জন্য দক্ষিণ সিটি টেমিফস ব্যবহার করে, আর উত্তর সিটি ব্যবহার করে নোভালিউরন, টেমিফস ও বিটিআই নামের ওষুধ। মশা মারতে ম্যালাথিয়ন ও ডেল্টামেথ্রিন দুই ওষুধই ব্যবহার করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। উত্তর সিটি শুধু ম্যালাথিয়ন ব্যবহার করে। এগুলো উড়ন্ত মশা মারার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার বিরুদ্ধে ডেল্টামেথ্রিন ওষুধ আর কাজ করছে না। এতে কেবল সময় ও অর্থের অপচয়ই হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ডা. কবিরুল বাশার বলেন, এখন যে ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা খুব বেশি কাজে দিচ্ছে না, বিশেষ করে ডেল্টামেথ্রিন। কারণ, মশার ইনসেক্টিসাইড রেজিস্ট্যান্স বা কীটনাশক-সহনশীলতা তৈরি হয়েছে। তবে ম্যালাথিয়ন ওষুধটি কার্যকর; কিন্তু প্রকৃতিতে এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব আছে।

রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এডিস মশার বংশবিস্তার রোধের বিকল্প নেই। সিটি করপোরেশন যেভাবে অভিযান আর জরিমানা করছে, তাতে সুফল মিলবে না। কীটতত্ত্ববিদদের সম্পৃক্ত করে অভিযান চালাতে হবে। কারণ, তারাই বুঝবেন কোথায় লার্ভা রয়েছে। এ জন্য দক্ষ জনবল নিতে হবে।

দক্ষিণ সিটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, চলতি বছরও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ। সুতরাং ডেঙ্গু এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ জন্য আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। তবে কিছুটা সময় লাগবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, এখন মৌসুম তুঙ্গে। জুলাই থেকে বৃদ্ধিটা শুরু হয়। আগস্ট মাসে সবচেয়ে তুঙ্গে যায়। সেপ্টেম্বর মাসে কমে আসে; কিন্তু গত বছর আমরা পরিবর্তন দেখেছি। চরিত্রে পরিবর্তন দেখেছি। দক্ষিণ সিটিতে পরিকল্পিত নগরায়ন কম হয়েছে। এখানে জনসংখ্যা বেশি, ভার বেশি। আমাদের এখানে ছোটখাটো পরিবেশ স্থাপনা বেশি। প্রতিকূলতা বেশি নিয়েই আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হচ্ছি।

উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু যাতে কোনোভাবে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। বাসার ভেতর, ছাদ ও বারান্দায় কোথাও কোনো পাত্রে যেন পানি না জমে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা-১৭ / পার্থর সঙ্গে লড়বেন তাসনূভা জাবীন

আইপিএল: নিলামে কোন দল কত খরচ করতে পারবে

কেন রণবীরকে ‘নির্লজ্জ’ বললেন পীযূষ মিশ্র!

আরও উন্নত ব্যাকআপ সুবিধা নিয়ে গুগল

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ২ ভাইয়ের

বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনসিপির প্রার্থী

সালাহউদ্দিন আহমদের আসনে এনসিপির প্রার্থী হলেন যিনি

সিলেটের ভাষায় সমর্থকদের যা বললেন আমির

ফেসবুক অ্যাপে আবারও বড় পরিবর্তন

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে হত্যার ঘটনায় সেই গৃহকর্মী গ্রেপ্তার

১০

আওয়ামী লীগকে নিয়ে জরিপ চালানোয় প্রশ্ন তুললেন প্রেস সচিব

১১

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে সিইসিসহ কমিশনাররা 

১২

বাগেরহাট ও গাজীপুরের সীমানা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল

১৩

খালেদা জিয়ার আসনে প্রার্থী দিল এনসিপি

১৪

কাজের সন্ধানে এসে লাশ হয়ে ফিরলেন শুক্কুর

১৫

বিএনপির যে প্রার্থীর বিপক্ষে লড়বেন নাহিদ ইসলাম

১৬

কোচকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠাল ৩ ক্রিকেটার, জানা গেল কারণ

১৭

আগুনে পুড়ল ঝুট গুদামসহ ১৩টি দোকান 

১৮

এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা / নির্বাচনে যে আসন থেকে লড়ছেন হান্নান মাসউদ-সারোয়ার তুষার    

১৯

এই ৬ অভ্যাস নীরবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আপনার মেরুদণ্ডকে

২০
X