আতাউর রহমান
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৩, ০৯:০৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকার রাস্তায় ভিক্টর ক্লাসিকের দাপট

‘খেপে’র বলি মানুষ

নাম পাল্টিয়েও অপকর্ম
ভিক্টর পরিবহনের বাসচাপায় নিহত মেহেদী হাসানের ছবি হাতে মা পারভীন বেগমের আহাজারি। ছবি : কালবেলা
ভিক্টর পরিবহনের বাসচাপায় নিহত মেহেদী হাসানের ছবি হাতে মা পারভীন বেগমের আহাজারি। ছবি : কালবেলা

‘ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক আর হরতাল হোক—মালিকের হাতে প্রতিদিন ৩ হাজার ৫০০ টাকা তুলে দিতে হবে। এরপর টার্মিনাল থেকে বাসের চাকা ঘুরতেই গেট পাসের (পরিবহন শ্রমিকদের ভাষায় জিপি) নামে দিতে হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। রাস্তায় খরচ আছে আরও ৫ থেকে ৭০০ টাকা। ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত তিনটি ট্রিপ দিতে না পারলে এই টাকা জোগাড় করা কষ্টকর। এজন্যই গাড়ি চালাতে গেলে তাড়াহুড়া থাকে।’ গতকাল শুক্রবার দুপুরে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে কথাগুলো বলছিলেন ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসের চালক। ওই পরিবহনের আরও অন্তত ছয়জন চালক-হেলপারের সঙ্গে কথা বলেও মেলে অভিন্ন তথ্য।

পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকা থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল রুটে চলাচল করা ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাস প্রায়ই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে, পথচারীদের পিষে মারছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে চাপা দিয়ে হত্যা করে পালানোর সময়ে আরেক শিশুকে পিষে মারে। এরপর ফের আলোচনায় এসেছে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহন; যা পথচারীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে।

একই পরিবহন বারবার কেন দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে, সড়কে মানুষ মেরে কেন পার পেয়ে যাচ্ছে এবং চালক-হেলপাররা ভয়ডরহীন বেপরোয়া আচরণের পরও পার পেয়ে যাচ্ছে, সেই তথ্য খুঁজতে গিয়ে ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে আসে। ওই পরিবহনের বাস মালিক-শ্রমিক ও মালিক সমিতির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই রুটের প্রতিটি বাসই চালক-হেলপারের কাছে কন্ট্রাক্টে দিয়েছেন বাসের মালিকরা। প্রতিদিন চালক ও হেলপাররা যত টাকাই আয় করুন, মালিকের হাতে ৩ হাজার ৫০০ টাকা তুলে দিতে হয়। এই কারণে চালক ও হেলপাররা বেশি টাকার লোভে খ্যাপ বাড়ানোর জন্য বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে থাকেন। তা ছাড়া মালিকরা নিজেদের মতো করে ড্রাইভিং সনদ যাচাই-বাছাই ছাড়াই চালকদের কাছে বাস তুলে দিচ্ছেন। অনেক চালক ও হেলপার মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে সড়কে মরছে মানুষ।

ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের দুজন চালক কালবেলাকে জানিয়েছেন, ওয়ার্কিং ডেতে ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে বাইপাইল পর্যন্ত সর্বোচ্চ তিনটি ট্রিপ দিতে পারেন তারা। মালিকের সাড়ে ৩ হাজার টাকা, জিপির ১ হাজার ১০০ টাকা, সড়কে ট্রাফিক পুলিশসহ অন্যান্য খাতে আরও অন্তত ৫০০ টাকা, জ্বালানি খরচ দিয়ে প্রতিদিন একজন চালক সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা রুজি করতে পারেন। ছুটির দিন বা বৃষ্টির মধ্যে আবার এই আয় কমে আসে। তবে অন্যদের নিয়ম অনুযায়ী টাকা দিতেই হয়। এজন্য তারা খ্যাপ বাড়াতে দ্রুত গাড়ি চালান।

ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একজন পরিচালক ও বাস মালিক গোলাম ফারুক মানিক কালবেলার কাছে স্বীকার করেন, তাদের রুটে কিছুটা বিশৃঙ্খলা রয়েছে। বাসের মালিকরাই তাদের বাসে চালক ও হেলপার নিয়োগ দেন। তারা কার হাতে নিজের বাস তুলে দিচ্ছেন, সেটা তাদের বিষয়।

অন্য একজন পরিচালক বলেন, কোনো বাস দুর্ঘটনায় পড়লে বাস মালিকই চালক-হেলপার ও জব্দ করা বাস ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। এতে মালিক সমিতির কোনো দায় নেই। এজন্য মালিকদেরই ঠিক করতে হবে, তারা কার হাতে নিজের বাস তুলে দিচ্ছেন।

ভিক্টর পরিবহন বাসের একাধিক মালিক-শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই পরিবহনের মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন সরকারদলীয় প্রভাবশালী একজন এমপির এপিএস। এই রুটের পরিবহনের কোনো ঝামেলা হলে তিনিই সবকিছু দেখভাল করেন। এজন্য মালিক ও চালকরাও কাউকে পাত্তা দেন না।

অন্য একটি সূত্র জানায়, ওই রুটে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ভিক্টর পরিবহনের ১৮৭টি বাস চলাচলের রুট পারমিট রয়েছে। তবে ওই কোম্পানির নামে দুই শতাধিক বাস চলাচল করছে। এতে নিজেদের মধ্যে খ্যাপের প্রতিযোগিতা থাকায় ঘটছে দুর্ঘটনা।

ভিক্টর ক্লাসিকের কয়েকজন চালক ও হেলপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার ও রাতে মূলত হেলপাররা বাস চালিয়ে থাকেন। এভাবে তারা বাস চালানো শেখার সুযোগ পাওয়ায় এই পরিবহনে রোজগার কম হলেও থেকে যাচ্ছেন।

নাম পাল্টেও দুর্নাম যাচ্ছে না ভিক্টর পরিবহনের: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি সরকারের আমলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কয়েক নেতার আশীর্বাদে ভিক্টর পরিবহন শুরু হয়। এক সময়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে বাস ঢুকতে পারত না। তবে ওই সময়ের ক্ষমতাসীন নেতারা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের পাশে ভিক্টরের বাসস্ট্যান্ড গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে অন্যান্য পরিবহনের বাসও জগন্নাথের গেট ও বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে রাখা শুরু হয়। এখন ওই এলাকায় সিটি করপোরেশন বৈধভাবে বাস টার্মিনাল বানিয়েছে।

বাস মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভিক্টর পরিবহনের ব্যবস্থাপনাও বদলে যায়। তখন এটি হয়ে যায় ভিক্টর ক্লাসিক। সুযোগ বেশি হওয়ায় অন্যান্য রুটের বাসও এই রুটে যুক্ত হয়।

ভিক্টর পরিবহনের পুরোনো একজন মালিক জানান, ২০১৯ সালের মার্চে প্রগতি সরণিতে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। আন্দোলনের মুখে সুপ্রভাত পরিবহনের রুট পারমিট বাতিল করে বিআরটিএ। এরপর ওই কোম্পানির বেশিরভাগ বাস মালিক সমিতিকে টাকা দিয়ে ভিক্টর ক্লাসিকে যুক্ত হয়ে যায়। অনেক বাস যায় আকাশ পরিবহনে। এসব বাসই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।

ওই মালিকের কথার সত্যতা মেলে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি প্রগতি সরণিতে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের এক দুর্ঘটনার পর। ওইদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ভিক্টর ক্লাসিক বাসের চাপায় নিহত হওয়ার পর বেরিয়ে আসে ওই বাসটি সুপ্রভাত পরিবহনের ছিল। দুর্ঘটনার পর রং পাল্টে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনে যুক্ত হয়।

গত ৬ মাসে ভিক্টর ক্লাসিকের চাকায় পিষ্ট চারজন: বৃহস্পতিবার শুধু শিশুসহ দুজনকেই চাপা দিয়ে মারেনি ভিক্টর পরিবহনের বাস। এর আগে গত ২২ জানুয়ারি কুড়িল বিশ্বরোডে নাদিয়া সুলতানা নামে নর্দান ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে মারে একই পরিবহন। গত ২৫ এপ্রিল উত্তর বাড্ডা এলাকায় ভিক্টর ক্লাসিক বাসের চাপায় নিহত হন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ফিল্ড অফিসার সদরুল হক। ওই ঘটনায় আহত হন তার সহকর্মী মমিনুর রহমান।

চলতি বছর ওই চারজন ছাড়াও ২০১৯ সালে একই দিন তুরাগ এলাকায় ভিক্টর পরিবহনের চাপায় নিহত হন দুজন। ওইদিন সংগীত পরিচালক ও সুরকার পারভেজ রবকে পিষ্ট করে মারে ভিক্টর ক্লাসিকের চাকা। ওই সময় গুরুতর আহত হয়ে এখনো পঙ্গুত্ব বয়ে বেড়াচ্ছেন তার ছেলে ইয়াসির আলভী। তবে ওই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান আলভীর বন্ধু মেহেদী হাসান। পারভেজ রব (৫৬) প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক আপেল মাহমুদের চাচাতো ভাই ছিলেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাবেক স্ত্রীকে হত্যার পর যুবকের কাণ্ড

বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

নদীতে ভাসছিল নিখোঁজ চালকের মরদেহ, উধাও অটো

টাইফয়েড টিকার রেজিস্ট্রেশন মোবাইল থেকে যেভাবে করবেন

দুদকের দুই উপ-পরিচালক বরখাস্ত

দলের স্বার্থে খেলে কপাল পুড়ল দুই ক্রিকেটারের, দাবি অশ্বিনের

মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ আগুন 

আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ১২টা হাতি মরে গেছে : রিজওয়ানা

প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা

ঢাবির ১৮ হল সংসদের প্রার্থী ঘোষণা ছাত্রদলের

১০

স্টার্টআপে বিনিয়োগ ও পরামর্শ দেবে কমিউনিটি ব্যাংক

১১

মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ

১২

কুমিল্লায় ৫২টি পাসপোর্টসহ দালাল আটক

১৩

টাকা ছাড়াই খাওয়া যায় যে ক্যাফেতে, দিতে হবে প্লাস্টিক বর্জ্য

১৪

বঞ্চিত কর্মকর্তাগণের আবেদন পর্যালোচনা কমিটির ২য় প্রতিবেদন পেশ

১৫

হাসপাতালে গিয়ে মির্জা ফখরুলকে পেলেন না জামায়াতের প্রতিনিধি দল

১৬

দূরশিক্ষা ও বিজ্ঞানের মহীরুহ ড. শমশের আলীর মহাপ্রস্থান : এক জ্ঞানতাপস

১৭

একযোগে এনসিপির ১৫ নেতার পদত্যাগ

১৮

হাবিপ্রবির ১২ হাজার শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ ৬ লাখ টাকা 

১৯

শিশুদের হাঁপানি সম্পর্কে যা যা জানা জরুরি

২০
X