সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে যখন কেউ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন তার মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। গত ১৬ মে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মূল কিলার আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে গাড়িতে বৈঠকের সময় কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু ফোন করে মিন্টুকে এমপি হত্যার খবর জানিয়েছিলেন। পরে সেই ছবি আদান-প্রদানও করেন বাবু-মিন্টু। যে ছবিতে এমপি আনারকে বিবস্ত্র করে একটি চেয়ারে হাত, পা, মুখ বেঁধে রাখতে দেখা গেছে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন গ্যাস বাবু।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এমপি আনার ১২ মে কলকাতায় যাওয়ার পর ১৩ মে হত্যার শিকার হন। জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর ২২ মে সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, আনার হত্যার শিকার হয়েছেন। আনার যে হত্যার শিকার হয়েছেন, সেই তথ্য এর আরও এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ১৬ মে জানতেন মিন্টু। কিন্তু তিনি এই খবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আনারের পরিবারকে জানাননি।
কী উদ্দেশ্যে মিন্টু এ তথ্য গোপন করেছিলেন, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ১৬ মে ভাঙ্গায় শিমুল ও বাবুর বৈঠকে এমপি আনারকে হাত-পা বেঁধে রাখার ছবি দেখানো হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে মিন্টুকেও দেখিয়েছিলেন বাবু। ওই বৈঠকে শিমুল ও বাবুর মধ্যে টাকার লেনদেন নিয়েও কথা হয়েছিল। তবে এমপি আনারকে যে হত্যা করা হবে, সেই তথ্য মিন্টু আগে থেকেই জানতেন কি না, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শিমুল যে ছবি বাবুকে এবং পরে বাবু সেই ছবি মিন্টুকে দেখিয়েছিলেন। সেই ছবি পেয়েছে কালবেলা। ছবিতে দেখা যায়, একটি চেয়ারে বিবস্ত্র করে বেঁধে রাখা হয়েছে এমপি আনারকে। তার হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা। মুখ বেঁধে রেখেছে সাদা কাপড়ে, গলা বাঁধা গামছা দিয়ে এবং মাথা বাঁধা রয়েছে কালো একটি কাপড়ে।
ডিএমপি ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কলকাতা পুলিশ ও আমরা যখন এমপি আনারের সন্ধান পাচ্ছিলাম না, সেই মুহূর্তে আমরা বাংলাদেশে তিনজনকে (শিমুল, তানভীর ও শিলাস্তি) গ্রেপ্তার করি। তারা তিনজনই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। একদিকে জবানবন্দি, ভারতে গিয়ে ডিজিটাল তথ্য সংগ্রহ, ভারতে গ্রেপ্তার জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ধারাবাহিকতায় ঝিনাইদহ থেকে বাবুকে গ্রেপ্তার করি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে অপকটে স্বীকার করেছেন, শিমুলের সঙ্গে তিনি ভাঙ্গায় মিটিং করেছেন। সেখানে মৃত ব্যক্তির ছবি দেখিয়েছেন।
তিনি বলেন, বাবুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ছবিটা কাকে কাকে দেখিয়েছেন? তখন তিনি আরেকজন নেতার (মিন্টু) কথা বলেছেন। তার (বাবু) মোবাইলগুলো কোথায়? তিনি বলেন আরেকজন নেতার কাছে তার মোবাইল। গাড়ির ভেতরে টাকা-পয়সার কথাবার্তা বলা, তাকে (মিন্টু) টেলিফোন করা। এই তথ্যগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টুকে ডেকেছেন। মিন্টুর কাছে তথ্যগুলো জানতে চাইবেন। যদি সদুত্তর দিতে পারেন, তাহলে তিনি চলে যাবেন। তবে তিনি যদি সদুত্তর দিতে না পারেন, তাহলে তদন্ত কর্মকর্তা তার তদন্তের ধারাবাহিকতায় যা করার সেটাই করবেন।
এমপিকে হত্যা করা হয়েছে, তা জেনেও মিন্টুসহ অন্যরা কেন তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নিহতের পরিবারকে জানাননি, সে বিষয়ে মিন্টুর কাছে জানতে চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি ডিবিপ্রধান হারুন। তিনি বলেন, এমপিকে হত্যা ও পরে গুম করার পর শিমুল ভূঁইয়া ১৫ মে দেশে আসেন। দেশে আসার পর ১৬ তারিখ ভাঙ্গা গেলেন। উনাদের ছবি দেখালেন। যাদের দেখানো হয়েছে, এমপি সাহেবের বাড়ি যেখানে তারাও একই জেলার। জনপ্রিয় এমপিকে মারার তথ্য পেয়ে সেটা হজম করলেন। কেন হজম করলেন, সেটা জানতে চাইবেন আমাদের তদন্ত কর্মকর্তা।
তদন্তের প্রয়োজনে তদন্ত কর্মকর্তা যখন যাকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন মনে করবেন, তখনই ডাকবে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। ডিবি কাউকে অযথা হয়রানি করে না এবং অপরাধীকে পালানোর সুযোগও দেয় না বলে দাবি করেন ডিবি হারুন।
গত মঙ্গলবার বিকেলে মিন্টুকে ডিবি হেফাজতে নেওয়ার পর বিভিন্ন পক্ষ থেকে তদবির করা হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে জানিয়েছেন এমপি আনারকন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। তিনি সচিবালয়ে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এরই মধ্যে অনেককে আটক করা হয়েছে। আমি শুনেছি, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক জায়গা থেকে তদবির করা হচ্ছে।
ডরিন বলেন, আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গ্যাস বাবু ও সাইদুল কাকা এসেছিলেন। আমি যখন ডিবি অফিসসহ প্রতিটা জায়গায় হাউমাউ করে আসছি, আমার বাবা নিখোঁজ, তখন তারা জেনেও কেন আমাকে জানালেন না? তারা বিষয়টা হাইড করেছেন। গোপন করাটাও অপরাধ।
সাক্ষাতের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সে (ডরিন) বলছে, কেউ যেন পার না পেয়ে যায়, বিষয়টি দেখবেন। যেটি আপনার তদন্তে আসবে আমরা সেটি বিশ্বাস করি। তদন্ত যেভাবে করেছেন তাতে যেন কেউ পার না পেয়ে যায়, সেই বিষয়ে আমাদের অনুরোধ করে গেছেন। এ বিষয়ে কোনো চাপ আছে কি না—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কে চাপ দেবে আমাদের, কোনো চাপ নেই। সঠিক পদ্ধতিতে তদন্ত হচ্ছে।