সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের কয়েক গুণ বেশি টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে অনেকে চাকরি পাচ্ছেন না। আবার দালালদের বিভিন্ন প্রলোভনে অনেকে বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন। অনেককে আবার শূন্যহাতে ফিরতে হয়। দালালের খপ্পরে পড়ে টাকা দিয়ে অনেকে বিদেশ যেতে পারেন না। প্রতিনিয়ত এমন অহরহ খবর শোনা গেলেও বিদেশযাত্রায় কমছে না দালালনির্ভরতা। অর্থাৎ এখনো দালালই ভরসা বিদেশযাত্রায়। এতে খরচও বেশি হয়। শহরের তুলনায় এ ঘটনা বেশি ঘটে গ্রামাঞ্চলে। বিদেশ যেতে সবচেয়ে বেশি দালালনির্ভর সিলেট বিভাগের মানুষ। বিদেশ যেতে অধিকাংশ মানুষ ঋণ করেন। ঋণ করে বিদেশ যান বেশি বরিশালের মানুষ। অন্যদিকে সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ ফেরত আসছেন। সবচেয়ে বেশি ফেরত আসছেন চট্টগ্রামের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিবিএস। এতে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি দালালকে টাকা দিয়ে বিদেশ গেছেন। রংপুর ছাড়া বেশিরভাগ বিভাগে অভিবাসন খরচের জন্য দালালদের ওপর ব্যাপক নির্ভর করতে হয়।
জরিপে চাকরি বা বসবাসের জন্য বিদেশে যাওয়াকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেসব ব্যক্তি নিজ দেশ ছেড়ে গন্তব্য দেশে ন্যূনতম ছয় মাসের জন্য থাকেন, তাদের আন্তর্জাতিক অভিবাসী বলা হয়।
জরিপে দেখা যায়, যারা বিদেশ গেছেন তাদের ৫২ দশমিক ০৩ শতাংশ মানুষ দালালকে টাকা দিয়েছেন। এই হার শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি। যেখানে বিদেশ যেতে দালালকে টাকা দিয়েছেন শহরের ৪৮ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষ, সেখানে দালালকে টাকা দিয়ে বিদেশ গেছেন ৫৩ দশমিক ১০ শতাংশ গ্রামের মানুষ।
বিদেশযাত্রায় ভোগান্তি কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও সরকারিভাবে খুব বেশি মানুষ বিদেশ যাচ্ছেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গেছেন মাত্র ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ মানুষ। আর দালারের বাইরে বেসরকারি কোম্পানি বা এজেন্সিগুলোকে টাকা দিয়ে বিদেশ গেছেন ৪২ দশমিক ০৯ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্যভাবে বিদেশ গেছেন ২ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বিদেশ গমনে সবচেয়ে বেশি দালালনির্ভর সিলেট বিভাগের মানুষ। এই বিভাগের ৫৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ মানুষ বিদেশে গেছেন দালালের মাধ্যমে। এর পরই ময়মনসিংহ (৫৭.৪৪ শতাংশ) বিভাগের অবস্থান। শুধু বরিশাল ও খুলনা বিভাগে এ হার ৫০ শতাংশের কম। বরিশালে দালাল ব্যবহার করেছেন ২৮ দশমিক ৮২ শতাংশ অভিবাসী এবং খুলনায় এ হার ৪৫.৩৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসনের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সমস্যা। শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের সম্পৃক্ততা দরিদ্র কর্মীদের খরচ বাড়িয়ে দেয়।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান কালবেলাকে বলেন, সাধারণত আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ঢাকানির্ভর। এ কারণে গ্রামাঞ্চলের কোনো মানুষ যখন চিন্তা করেন বিদেশ যাবেন; তখন তাকে কোন দেশে যাবেন, চাহিদা কেমন, কী কাজ করবেন এসব বিষয়ে সেবা দেওয়ার কেউ থাকেন না। এই সুযোগটা কাজে লাগায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। বিদেশ থেকে আনার ক্ষেত্রেও মধ্যস্বত্বভোগী গড়ে উঠেছে। এদের কারণে আমাদের দেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার খরচ সবচেয়ে বেশি এবং আয় সবচেয়ে কম।
তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে সচেতনতা জরুরি। পাশাপাশি বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি সেবাগুলোকে আরও সহজ করতে হবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জটিলতা এবং সব জায়গায় রিক্রুটিং এজেন্সি না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিদেশ যাওয়ার আগে পাসপোর্ট, মেডিকেলসহ যাবতীয় কাজে মানুষ দালারনির্ভর হয়ে যায়। তাই সেবার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ ঋণ করে বিদেশে যান। ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ মানুষ বিদেশ যেতে ঋণের ওপর নির্ভর করেন। শহরের তুলনায় ঋণ করে বিদেশ যান বেশি গ্রামের মানুষ। শহরে যেখানে ৫১ দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষ ঋণের ওপর নির্ভর করেন, সেখানে ৬০ দশমিক ০৭ শতাংশ গ্রামের মানুষ বিদেশ যেতে ঋণ নিয়েছেন। নারীদের তুলনায় পুরুষরা অনেক বেশি ঋণ নিয়ে থাকেন। ৩৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ নারী বিদেশ যেতে ঋণ নেন। সেখানে পুরুষের ঋণ নেওয়ার হার ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিদেশ যেতে সবচেয়ে বেশি ঋণনির্ভর বরিশাল বিভাগের মানুষ। বিদেশ যেতে এই বিভাগের ৬৮ দশমিক ৫১ শতাংশ মানুষ ঋণ নেন। ঋণ নেওয়ার হার সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। এই বিভাগের ৪৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে বিদেশ যান।
ব্রিটেন ও কানাডা বাদে বেশিরভাগ দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীরা শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন। শ্রমিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি গেছেন মালদ্বীপে ৯৮.০৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৯৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ ও সৌদি আরবে ৯৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এই দেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা বেশি। এসব দেশে পুরুষ বেশি গেছেন। নারীরা বেশি গেছেন কুয়েতে ৭২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ওমানে ৫৫ দশমিক ২২ শতাংশ ও সৌদিতে ৫০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
বিদেশ যাওয়ার পাশাপাশি স্থায়ীভাবে ফিরেও আসছেন অনেকে। সবচেয়ে বেশি ফেরত এসেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। সবচেয়ে বেশি মানুষ ফেরত আসছেন সৌদি থেকে ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর পরও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৪ দশমিক ০২ এবং মালয়েশিয়া থেকে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ মানুষ ফেরত এসেছেন।
বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ফেরত এসেছেন চট্টগ্রামের মানুষ। ফেরত আসাদের মধ্যে ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগের ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। সবচেয়ে কম ফেরত এসেছেন রংপুর বিভাগের মানুষ, ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। দেশে ফেরত আসাদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি।
জরিপে গত ৫ বছরের মধ্যে বিদেশ থেকে যারা স্থায়ীভাবে দেশে ফেরত এসেছেন, তাদের বিদেশফেরত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফিরে আসার কারণ সংক্রান্ত উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিদেশফেরতদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭.২৮ শতাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২.৮০ শতাংশ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ফেরত পাঠানো হয়েছে ১১.৬৭ শতাংশ, স্বাস্থ্যগত কারণে ৯.২৪ শতাংশ, করোনার কারণে ৯.২১ শতাংশ, পরিবারের সঙ্গে বসবাসের জন্য ৭.৯৬ শতাংশ এবং কাজ হারানোর কারণে ৭.১৮ শতাংশ ব্যক্তি স্থায়ীভাবে ফেরত এসেছেন।
বিদেশ গমনকারীদের বেশিরভাগ পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এই হার ৫৩.৯১ শতাংশ। এসএসসি বা সমমান পর্যন্ত পড়াশোনা করে বিদেশ গেছেন ১০.৭৫ শতাংশ এবং এইচএসসি বা সমমান পর্যন্ত পড়াশোনা করে বিদেশ গেছেন ১৮.৯৬ শতাংশ। যারা কখনো স্কুলে যাননি, এমন অভিবাসী ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।
অধিকাংশ মানুষ বিদেশ যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন না। জরিপে বলা হচ্ছে, বিদেশ যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ। প্রশিক্ষণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি যান রংপুর বিভাগের মানুষ, এই হার ৪০.৮৩ শতাংশ। সিলেট বিভাগে সর্বনিম্ন ৫.৪০ শতাংশ মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে শরিফুল হাসান বলেন, দেশের মানুষের প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রতি অনীহা রয়েছে। তারা ৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যেতে চান, কিন্তু ১০ হাজার টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণ নিতে চান না। যে কারণে বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের সংকট এবং বিপদের সম্মুখীন হন। ভালো কাজ এবং ভালো বেতনের জন্য দক্ষতার বিকল্প নেই। অভিবাসীদের দক্ষতা বাড়িয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ।