

একটি প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’। মানুষের জন্য কাজ করলে মানুষও খুশি হয়, সৃষ্টিকর্তাও খুশি হন। আর মানুষের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতেই পৃথিবীতে ইসলামের আগমন। ইসলামের এই কল্যাণকামিতা তার প্রতিটি বিধি-বিধানে প্রতিভাত হয়েছে। ইসলামী অর্থব্যবস্থার এমনই একটি কল্যাণকর দিক হলো অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া এবং অন্যের স্বার্থ রক্ষা করা। ইসলামী পরিভাষায় অন্যকে প্রাধান্য দেওয়াকে ‘ইসার’ বলা হয়। পবিত্র কোরআনে সেসব মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে, যারা নিজেদের প্রয়োজন থাকার পরও অন্যকে প্রাধান্য দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদের জন্যও, মুহাজিরদের আগমনের আগে যারা এই নগরীতে বসবাস করেছে ও ইমান এনেছে, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না, আর তারা তাদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৯)।
অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া বলতে আসলে কী বোঝায়? প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, ইসার তথা অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার অর্থ হলো—জাগতিক প্রয়োজন, উপকার লাভ বা ক্ষতি থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্য দেওয়া। এটাই ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সর্বোচ্চ স্তর। মহানবী (সা.) ইসারকে ইমানের দাবি আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মদের জীবন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেই কল্যাণ পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৫০১৭)
ইসলামে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইসার বা অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার বহুমুখী কল্যাণ রয়েছে। অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া এমন একটি উত্তম গুণ, যার প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মতো মহান ব্যক্তিরা তাঁদের জীবনে তা ধারণ করেছেন। মূলত সাহাবিদের ভেতর ইসারের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকায় হিজরতের পর মদিনার সমাজ ও অর্থনীতিতে যে চাপ পড়েছিল তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। আনসার ও মুহাজির সাহাবিরা পরস্পরের হাত ধরে সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে পুরো মুসলিম সমাজই এগিয়ে গিয়েছিল। নবীজি (সা.)-এর মাধ্যমে পরবর্তী উম্মতের সামনে উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যান যে তারা পরস্পরকে নিজের ওপর কিভাবে প্রাধান্য দেবে। তিনি ইসার বা অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার গুণবিশিষ্ট মুসলিম সমাজ সম্পর্কে বলেন, নোমান বিন বশির (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদের একটি দেহের মতো দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ নেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১১)
মুমিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্য মুমিনকে প্রাধান্য দেবে। এটা আর্থিক ও জাগতিক বিষয়েও। যেমন খাদ্যের ব্যবস্থা করা আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়ে। খাদ্য ব্যবস্থাপনায় মহানবী (সা.) অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার একটি ব্যবস্থা শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এক ব্যক্তির খাবার দুইজনের জন্য যথেষ্ট, দুই ব্যক্তির খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট এবং চার ব্যক্তির খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২০৫৯)। হাদিসের ব্যাখ্যায় আলেমরা বলেন, কোনো ব্যক্তির কাছে যদি এই পরিমাণ খাবার থাকে, যা একজনের জন্যই যথেষ্ট, তবে সে অন্যের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে আরেকজনকে অন্তর্ভুক্ত করে নেবে। এটা হলো ক্ষুধা নিবারণে নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার একটি রূপ। কেউ যদি এমনটি করে তবে আল্লাহ তাকে বরকত ও তৃপ্তি দান করবেন। তাই কোনো ব্যক্তির জন্য নিজের কাছে থাকা খাদ্য অন্যের সামনে উপস্থাপন করতে কার্পণ্য করা উচিত নয়।
অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার আরেকটি রূপরেখা হাদিসে পাওয়া যায়। আবু মুসা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘আশআরি গোত্রের লোকেরা যখন জিহাদে গিয়ে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে বা মদিনায় তাদের পরিবার-পরিজনদের খাবার কম হয়ে যায়, তখন তারা তাদের যা কিছু সম্বল থাকে, তা একটা কাপড়ে জমা করে। তারপর একটা পাত্র দিয়ে মেপে তা নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নেয়। কাজেই তারা আমার এবং আমি তাদের।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৮৬)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইসার বা অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার একটি উদ্দেশ্য সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করা।
ইসলামী অর্থব্যবস্থায় অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া শুধু নিজের স্বার্থ ত্যাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাতে অন্যের জন্য অর্থ ব্যয় বা আর্থিক সহযোগিতাও অন্তর্ভুক্ত; এমনকি সেই নিঃস্বার্থ ব্যয়ে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেটা এভাবে যে অন্যের জন্য নিজের সম্পদের উত্তম অংশ ব্যয় করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যা ভালোবাসো তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করবে না। তোমরা যা কিছু ব্যয় করো আল্লাহ অবশ্যই সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯২)
অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার কিছু শর্ত রয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওজি (রহ.) অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার কয়েকটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। তা হলোÑ ১. প্রাধান্য দানকারী ব্যক্তির সময় নষ্ট না হওয়া। অর্থাৎ অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে উপকারী সময়ের বিবেচনায় ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া। ২. অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া নিজের ক্ষতির কারণ না হওয়া। ৩. এটা যে প্রাধান্য দিল এবং যাকে প্রাধান্য দিল কারো দ্বিনদারির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করা। ৪. এই প্রাধান্য যাকে দেওয়া হয়েছে তার কল্যাণ লাভের পথে বাধা হবে না। ৫. যাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে তার পক্ষ থেকে বাধা, নিষেধ বা অনীহা না থাকা। (আর-রাকায়িক ওয়াল আদাব ওয়াল আজকার : ১/১০৩)
ইসলামের ইতিহাস থেকে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। হাবিব ইবনে আবি সাবিত (রহ.) থেকে বর্ণিত, ইয়ারমুকের যুদ্ধের দিন হারিস ইবনে হিশাম, ইকরামা ইবনে আবি জাহাল ও আয়াশ ইবনে আবি রাবিয়া (রা.) গুরুতর আহত হলেন। তখন হারিস (রহ.) পানি পান করতে চাইলেন। তাঁর নিকট পানি আনা হলো। তিনি ইকরামা (রা.)-কে দেখে বললেন, পানি তাঁকে দাও। ইকরামা (রা.)-এর কাছে পানি নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আয়াশ (রা.)-কে দেখে বললেন, পানি তাঁকে দাও। কিন্তু পানি তাঁর কাছে পৌঁছার আগেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এভাবে তাঁদের সবাই পানি পান না করেই শহীদ হয়ে যান। (মুসতাদরাক, হাদিস : ৫১২৪) আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের সঠিক বুঝ দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব
মন্তব্য করুন