আকমল হোসেন
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

এক সপ্তাহ ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি চলছে শিক্ষা জাতীয়করণ মহাজোট নামক সংগঠনের ব্যানারে। এদিকে শাহবাগে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত ৬ হাজার ৫৩১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের পক্ষে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকরা অবস্থান করছেন। তারা দুই দফা পুলিশের জলকামানের পানি ও লাটিচার্জের পর পুলিশের সামনে গুলি করার জন্য বুক পেতে দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। তারই পাশে মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের এনটিআরসির নিবন্ধিত ১ম-১২তম ব্যাচের উত্তীর্ণরা নিয়োগের দাবিতে সপ্তাহ ধরে অবস্থানে রয়েছেন।

এর আগে সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে থানা, জেলা বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে এবং সরকারকে তাদের চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি জানায়। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সর্বশেষ ভরসা হিসেবে ঢাকায় এসেছেন কর্তাব্যক্তিদের নজরে আনার জন্য, মিডিয়ার বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কারণ মফস্বলের মানুষ যে মানুষ, তাদের যে অভাব আছে, সমস্যা আছে বা থাকতে পারে—সেটা এসিরুমের নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছানো নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছে। এ স্বল্পতা শিক্ষার্থীর অনুপাতের ঘাটতির কারণে চাকরি থেকে অবসর এবং চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে যোগদানের কারণে। এ ছাড়া শিক্ষাকাজ ছাড়াও ভোটার তালিকাসহ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের কাজের সঙ্গে যুক্ত করার কারণে।

২০২৩ সালের বিজ্ঞপ্তির আলোকে দেশের অন্যান্য জায়গায় নিয়োগের কাজ শেষ হলেও তৃতীয় ধাপে ৬ হাজার ৫৩১ জন সহকারী শিক্ষকের নিয়োগের কাজ চূড়ান্ত হয় গত বছর ৩১ অক্টোবর। তারা সবাই নিয়োগপত্র হাতে পায়। যোগদানের পূর্বমুহূর্তে সুপারিশবঞ্চিত ৩১ জন শিক্ষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোর্ট তাদের নিয়োগ স্থগিত করে। অন্যদিকে ১ম-১২তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষকদের নিয়োগ না দিয়ে এবং তাদের সময়কার নিয়োগের বয়সের সময়সীমা না থাকলেও পরবর্তীকালে ৩৫ বছরের পর বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী পেশায় নিয়োগ হবে না বলে সরকার নীতিমালা জারি করে। ফলে ১ম-১২তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষকদের বয়স ৩৫ বছর অতিক্রম করায় তারা আর নিয়োগ পাচ্ছেন না। নিবন্ধন পরীক্ষা চাকরি প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে না বিধায় তাদের এ সংকট।

একটি স্বাধীন দেশে শিক্ষার এ হাল মানুষকে ভাবাচ্ছে। আমলাদের বয়ান শিক্ষার সংকট দূরীকরণে জাতীয়করণ অন্যতম প্রধান কারণ। তবে সেটা করা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এটা করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দল এবং সরকারের। এটি করতে জাতীয় বাজেটে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি, নির্বাচনী ইশতেহার এবং সরকারের নীতিগত জায়গায় প্রতিশ্রুতির বিষয়টি পরিষ্কার থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক অনেকগুলো সমঝোতা স্মারকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার স্বাক্ষর করলেও সে অনুযায়ী তাদের দলীয় কর্মসূচি এবং নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষা জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেনি; বরং বামপন্থিরা ছাড়া সব রাজনৈতিক দল সেবা খাত উদারীকরণের নামে শিক্ষাকে বেসরকারীকরণ করার পক্ষে। এমনতর বাস্তবতায় সব শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে শিক্ষা জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি নিতে পারলে কিছু একটা হতে পারে। শিক্ষক সংগঠনগুলোকে তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করা এবং সেই আলোকে শিক্ষকদের সংগঠিত করে আন্দোলন করতে হবে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে নেই এমন দাবি করে আন্দোলন করলে দাবি আদায় সম্ভব নয়। পেশাজীবী সংগঠনের বৈশিষ্ট্যকে ত্যাগ করে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা অসম্ভব। ৫৩ বছর তার প্রমাণ।

শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের এ দাবি ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি প্রথম করলেও আজ সেটি সব শিক্ষক সংগঠনের কমন দাবিতে পরিণত হয়েছে। যদিও বিষয়টি সম্পর্কে সবাই পরিষ্কার নয়, সরকার তো নয়ই। সরকার নির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই বিক্ষিপ্তভাবে জাতীয়করণের তকমা দিয়ে যেটি করছে, সেটি স্রেফ সরকারীকরণ, যা শিক্ষকদের একাডেমিক ফ্রিডম হরণ করে সরকারি কর্মচারী হিসেবে তল্পিবাহকে পরিণত করে। ফলে শিক্ষার মূল কাজই ব্যাহত হচ্ছে বা হবে। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীর কিছুটা আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত হলেও মর্যাদাগত দিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের আলোকে সব স্তরের শিক্ষক-কর্মচারীরা পিছিয়ে আছে। এর আগে জাতীয়করণমুখী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মাউশির ডিজি এবং পরে শিক্ষামন্ত্রী অনেকগুলো শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেন কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে পৃথিবীর দেশে দেশে গৃহীত হলেও বাংলাদেশে সেই স্বীকৃতি পায়নি, সংবিধানের ১৫ ধারায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

মুদ্রাস্ফীতি, শিক্ষার্থীর ও শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন করে প্রতিষ্ঠানকে এমপিওকরণ, নতুন প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন, সব মিলিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু বৈষম্যের এখানেই শেষ নয়। যে টাকাই বরাদ্দ হয় তার একটা অংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। আরেকটি অংশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়, প্রকল্পের নামে আরেকটি অংশ তছরুপ হয়, সব মিলিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থও ব্যয় হয় না। একাডেমিক বিষয়টি রাজনীতি আর ভোটব্যাংকের সঙ্গে মেলাতে গেলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতিষ্ঠানসহ সব শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আদলে একটি নিয়োগ কমিশন করলে গুণগত মানের শিক্ষক পাওয়া সম্ভব। সেইসঙ্গে গভর্নিং বডির অযাচিত খবরদারি কমবে এবং শিক্ষকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং জোরপূর্বক ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক পদত্যাগের বিশ্বসেরা কলঙ্ক থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবিটা সবারই কাঙ্ক্ষিত।

লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এসিআই-এ নিয়োগ, আবেদন করুন অনলাইনে

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

বসতভিটা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি, সন্তানের বিরুদ্ধে বাবার মামলা

ব্রাজিলের মন্ত্রীর মার্কিন ভিসা বাতিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেন লুলা

ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে রুমমেটকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, কী বললেন প্রক্টর

শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ আটক

২৭ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২৭ আগস্ট : টিভিতে আজকের খেলা 

আজ থেকে নতুন দামে বিক্রি হবে স্বর্ণ

২৭ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১১

কৃষিবিদ আসাদুজ্জামান কিটোনকে সংবর্ধনা দিল এ্যাব

১২

মাছ ধরার নৌকায় মিলল সাড়ে ৪ লাখ পিস ইয়াবা, আটক ৯

১৩

ভোলায় নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল / এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

১৪

যৌথ বাহিনীর অভিযানে অনলাইন জুয়া চক্রের ২ সদস্য আটক

১৫

জেলেরা হেলমেট পরে মাছ ধরেন যেখানে

১৬

বিমানবাহিনীর আন্তঃঘাঁটি স্কোয়াশ প্রতিযোগিতা সমাপ্ত

১৭

স্পেনে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

১৮

কারাগারে সন্তান জন্ম দিলেন হত্যা মামলার আসামি

১৯

সিলেটের সাদাপাথর লুটের ঘটনায় সিআইডির অনুসন্ধান শুরু

২০
X