ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্ৰয় হেতবে।
নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতিঃ পরমেশ্বর॥
প্রতি চান্দ্র মাসে একটি শিবরাত্রি হয় (প্রতি বছর ১২টি)। প্রধান উৎসবকে বলা হয় মহাশিবরাত্রি, যা ১৩তম রাতে (অস্তমিত চাঁদ) ও ফাল্গুন মাসের ১৪তম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। মাসের চতুর্দশী এ মহাশিবরাত্রি পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হলো হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব ‘শিবের মহারাত্রি’। অনুসারে, এ রাত্রেই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহা করেছিলেন। আবার এ রাত্রেই ও বিয়ে হয়েছিল।
দৃক পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, এ বছর চতুর্দশী তিথি শুরু ১৩ ফাল্গুন, ২৬ ফেব্রুয়ারি, বুধবার বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটে আর এ তিথির সমাপ্তি ১৪ ফাল্গুন, ২৭ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, সকাল ৯টা ২৪ মিনিটে। তিথির দৈর্ঘ্য প্রায় ২১ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট। সনাতন ধর্মচারীরা যারা এ ব্রত অনুশীলন করবেন, তাদের একটানা ২১ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট উপবাস থেকে এ ব্রতাচরণ করতে হবে। পরদিন সকালে প্রসাদ গ্রহণ করে উপবাস ভঙ্গ করতে পারবেন পুণ্যার্থী। একে বলা হয় পারণ। এ পারণের সময় হচ্ছে ১৪ ফাল্গুন, ২৭ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ৮টা ৫৯ থেকে ১০টা ২৪ মিনিট পর্যন্ত।
ব্যষ্টি ও সামষ্টিক অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার আরাধনায় এ ব্রত পালিত হয়। শিব শব্দের অর্থ মঙ্গল। তাই প্রতিটি মঙ্গলময় জিনিস বা ব্যক্তিত্ব হলো শিবস্বরূপ। শিব শব্দের উৎপত্তি শী-ধাতু (শয়ন) থেকে। তার মানে সবাই এবং সবকিছু যার মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত অর্থাৎ যিনি সবারই আশ্রয়। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সবকিছুর আশ্রয়, যা পরমব্রহ্মস্বরূপ অর্থাৎ নিরাকার ঈশ্বর যিনি সব গুণের আধার।
শিবপূজা করলে মানুষ মৃত্যুভয় থেকে ত্রাণ লাভ করে। এজন্য ‘মৃত্যুঞ্জয়’ শিবের আরেক নাম। সর্বযোগের অধিপতি মহাদেব। তাই তার আরেক নাম যোগীশ্বর বা যোগেশ্বর। সব বোধ দর্শন ও জ্ঞান তার অধিগত। সেজন্য তার অন্য নাম পশুপতি অর্থাৎ জ্ঞান ও দর্শনের অধিপতি। দাম্পত্য ও পারিবারিক কল্যাণ তার আশীর্বাদে নিশ্চিত হয়।
স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় শিব যতটুকু সন্তুষ্ট হন তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হন শিবরাত্রির উপবাসে। শিব অর্থাৎ মহাদেব বলেন, ব্রতপালনকারী ত্রয়োদশীতে স্নান করে সংযম পালন করবে। নিজে রান্না করে নিরামিষ বা হবিষ্যান্ন ভোজন করবে। স্থণ্ডিল (ভূমি বা বালু বিছানো যজ্ঞবেদী) অথবা কুশ বিছিয়ে শয়ন করে আমার (অর্থাৎ শিবের) নাম স্মরণ করতে থাকবে। রাত্রি শেষ হলে শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃক্রিয়াদি ও অন্যান্য আবশ্যক কার্যাদি করবে। সন্ধ্যায় যথাবিধি পূজাদি করে বিল্বপত্র সংগ্রহ করবে। তারপর নিত্যক্রিয়াদি করবে। অতঃপর স্থণ্ডিলে (যজ্ঞবেদিতে), সরোবরে, প্রতীকে বা প্রতিমায় বিল্বপত্র দিয়ে শিবের পূজা করবে। ভক্তিই এখানে প্রধান। একটি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করলে শিবের যে প্রীতি জন্মে, সকল প্রকার পুষ্প একত্র করে কিংবা মণি, মুক্তা, প্রবাল বা স্বর্ণনির্মিত পুষ্প দিয়ে শিবের পূজা করলেও তার সমান প্রীতি শিবের জন্মে না।
প্রহরে প্রহরে বিশেষভাবে শিবের প্রতীকে স্নান করিয়ে শিবের পূজা করতে হয়। পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বারা যথোচিত অর্চনা করা বিধেয়। এ বছর প্রথম প্রহরে দুগ্ধ দিয়ে (সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিট-রাত ৯টা ৫৬ মিনিট) [ইদং স্নানীয় দুগ্ধং নমঃ হৌং ঈশানায় নমঃ], দ্বিতীয় প্রহরে দধি দিয়ে রাত (৯টা ৫৬ মিনিট-রাত ১টা ৪ মিনিট) [ইদং স্নানীয় দধিং নমঃ হৌং অঘোরায় নমঃ], তৃতীয় প্রহরে ঘৃত দিয়ে (রাত ১টা ৪ মিনিট-রাত ৪টা ১১ মিনিট) [ইদং স্নানীয় ঘৃতং নমঃ হৌং বামদেবায় নমঃ] এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে (রাত ৪টা ১১ মিনিট-সকাল ৭টা ১৮ মিনিট) [ইদং স্নানীয় মধুং নমঃ হৌং সদ্যোজাতায় নমঃ] মন্ত্রে শিবকে স্নান করাতে এবং পূজা করতে হবে। এবার নিশীথ পূজার সময় রাত ১২টা ৩৯ মিনিট-১টা ২৯ মিনিট পর্যন্ত)।
এই প্রীতিকর ব্রত করলে তপস্যা ও যজ্ঞের পুণ্য লাভ হয় এবং ষোলোকলায় দক্ষতা জন্মে। এ ব্রতের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ হয়। শিবরাত্রি ব্রতে উপবাস চলে সারা দিন ও সারা রাত। পুণ্যার্থীরা ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ জপ করেন। এ ছাড়া মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রসহ অন্যান্য মন্ত্র জপ করা হয়। শিব অর্থাৎ মহাদেবের নামে ভজন-সাধনা করে সারা রাত জাগতে হয় পুণ্যার্থীকে।
এই ব্রতের মাহাত্ম্যে বর্ণিত আছে, পুরাকালে বারাণসী পুরীতে ভয়ংকর এক ব্যাধ বাস করত। ফাঁদ জাল, দড়ির ফাঁস এবং প্রাণী হত্যার নানারকম হাতিয়ারে পরিপূর্ণ ছিল তার বাড়ি। একদিন সে বনে গিয়ে অনেক পশু হত্যা করল। তারপর নিহত পশুর মাংস নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। পথে ক্লান্ত হয়ে সে বনের মধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি বৃক্ষমূলে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের বেলায় ব্যাধ জেগে উঠল। ঘোর অন্ধকারে কোনো কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে একটি শ্রীফলবৃক্ষ অর্থাৎ বিল্ববৃক্ষ পেল। সেই বিল্ববৃক্ষে লতা দিয়ে তার সংগ্রহ করা মাংস বেঁধে রাখল। বৃক্ষতলে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে। এই ভেবে সে নিজেও ওই বিল্ববৃক্ষে উঠে পড়ল। ক্ষুধায় সে পর্যুদস্ত। এভাবে সে শিশিরে ভিজেই জেগে কাটাল সারা রাত।
দৈববশত সেই বিল্ববৃক্ষমূলে ছিল শিবের একটি প্রতীক। তিথিটি ছিল শিব চতুর্দশী। আর ব্যাধও সেই রাত কাটিয়েছিল উপবাসে। তার শরীর থেকে শিবের প্রতীকের ওপর হিম বা শিশির ঝরে পড়েছিল। তার শরীরের ঝাঁকুনিতে বিল্বপত্র পড়েছিল শিবের প্রতীকের ওপর। নিজের অজান্তেই ব্যাধ শিবরাত্রিব্রত করে ফেলে। পরদিন ব্যাধ নিজের বাড়িতে চলে গেল।
কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হলে যমদূত তার আত্মাকে নিতে এসে তাকে যথারীতি যমপাশে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হলো। অন্যদিকে ব্যাধের করুণ আর্তি শুনে শিবের প্রেরিত দূত ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে এলো। বাধাপ্রাপ্ত যমদূত যমরাজকে নিয়ে শিবের পুরদ্বারে উপস্থিত হলো। দ্বারে শিবের অনুচর নন্দীকে দেখে যম তাকে সব ঘটনা বললেন। এই ব্যাধ সারা জীবন ধরে কুকর্ম করেছে—জানালেন যম।
নন্দী বললেন, ধর্মরাজ, এতে কোনো সন্দেহই নেই যে ওই ব্যাধ দুরাত্মা। সে সারা জীবন অবশ্যই পাপ করেছে। কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্ম্যে সে পাপমুক্ত হয়েছে এবং সর্বেশ্বর শিবের কৃপা লাভ করে শিবলোকে এসেছে। নন্দীর কথা শুনে বিস্মিত হলেন ধর্মরাজ। তিনি শিবের মাহাত্ম্যের কথা ভাবতে ভাবতে যমপুরীতে চলে গেলেন।
শিব-উপাসনা যে ঠিকমতো করে, তার অন্তর হয়ে ওঠে অভী ভাবনায় উজ্জীবিত। প্রকৃত ধর্মাচরণই মানুষকে অভী বা ভয়শূন্য করে তোলে। তথাকথিত হাজার রকমের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভয় বা আতঙ্ক তাকে সংকুচিত ও ত্রস্ত করে তুলতে পারে না। সে জানে শরীরের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। আত্মা চির-অবিনশ্বর এবং প্রতিটি মানুষই সেই বিশ্বাত্মারই অংশবিশেষ। সদগুরুর ওপর গভীর টান মানুষকে এমনতর মৃত্যুভয়-অতিক্রমী সাহসী অথচ কল্যাণপথিক করে তোলে। দেবতাদের মধ্যে শিব মহান বিধায় তার আরেক নাম মহাদেব। ঠিক তেমনি বাকি দেবতার ভক্তদের মধ্যে সঠিক শৈবভক্ত মহান অর্থাৎ তার মধ্যে সঠিকভাবে শিবত্বের গুণগুলো প্রকটভাবে দেখা যায়।
শিবের কাছে তাই সব ভক্তের প্রার্থনা, তুমি জন্ম, জীবন ও মৃত্যু—এই ত্রয়ী জ্ঞানদৃষ্টির অধিকারী। তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের জোগানদাতা। তুমি সব ভয়ংকর ব্যাধি হতে ত্রাণদানকারী। রোগ, শোক, দুর্ঘটনা ও সব অকল্যাণ থেকে আমাদের মুক্ত করো। আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তিদান করো, অমৃতত্ব থেকে নয়।
ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি।
লেখক: ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমিটির উপদেষ্টা পুরোহিত
সম্পাদক, জয় বাবা লোকনাথ পঞ্জিকা এবং অতিরিক্ত সচিব (অব.)
মন্তব্য করুন