মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সেকালের ঢাকা স্মৃতিতে বিস্ময়

সেকালের ঢাকা স্মৃতিতে বিস্ময়

বসবাসের যোগ্যতার প্রশ্নে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবক্ষয়, আবহাওয়ার দূষণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিবেচনায় রাজধানী ঢাকা সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছতে পারেনি আজও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, রাজধানী ঢাকা রয়েছে অনেকটা পিছিয়ে। পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বারবার পেছনের সারিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। ষাট-সত্তরের পুরোটা সময় আমি থেকেছি ঢাকার মগবাজারে ঝিলপাড়ে একটি ভারি সুন্দর বাসায়। চারদিকে সবুজ গাছপালা, লতাগুল্ম। ঘরের জানালা খুলে দিতে নির্মল বাতাসে ভরে দিত ঘর। ঝিলের জলের টলটলে পানিতে অফুরন্ত মাছ ঘুরে বেড়াত। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় তখন নিরিবিলি। শুধু বিজি প্রেস, নাবিস্কো, হক বিস্কুট ফ্যাক্টরি, ঢাকা পলিটেকনিক ও টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ছাড়া বড় স্থাপনা খুব একটা ছিল না। গাছপালা ভরা এলাকাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘরে দেখা যেত সীমিত চেনাজানা মানুষ। আজকের কর্মব্যস্ত টঙ্গী ডাইভারশন রোড তখন ছিল ছোট্ট মেঠোপথ। খানাখন্দে ভরা উঁচু-নিচু সরু রাস্তা সাতরাস্তার মোড় থেকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে মগবাজার পর্যন্ত। মাঝে বেগুনবাড়ী খালের ওপরের উঁচু কালভার্ট টপকে পার হতে হতো। আজকের জনবহুল জমজমাট এফডিসির সামনে তখন ছিল মজা ডোবা। তখন তেজগাঁও এলাকার একমাত্র কারওয়ান বাজারে সীমিত দোকানপাটে দেখা যেত অল্প লোকজন। মোস্তফা নামের একজন পেপার হকার খালি রাস্তায় জাঁকিয়ে সাইকেল চালিয়ে আমাকে নিয়মিত পত্রিকা দিত। পত্রিকায় পাতায় নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখে বন্ধুদের তা দেখাতাম। টঙ্গী ডাইভারশন রোডের দুধারে মগবাজার ঝিলে ধরা মাছের বাজার বসত নিয়মিত। নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যেত চাপলিসহ নানা ধরনের মাছ। দেড়শ টাকায় চলে যেত এক পুত্রসহ স্ত্রী ও আমার মাসিক খরচ! দেড়শ টাকায় বানিয়ে ছিলাম জীবনের প্রথম কমপ্লিট স্যুট। সন্ধ্যায় নিউমার্কেটে দেখা হতো অনেক কবি, লেখকের সঙ্গে। কখনো রেসকোর্স, রমনা পার্কে আড্ডা জমত।

ষাট-সত্তর দশকের ঢাকা শহরে যানবাহনের সংখ্যা ছিল নিতান্ত কম। বাসে ওঠা যেত অনায়াসে। রিকশা ছিল সহজলভ্য। স্কুটারে শখ করে কালেভদ্রে মানুষ চড়ত। যন্ত্রচালিত গাড়ির সংখ্যা ছিল একেবারে হাতেগোনার মতো। তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মেঠোপথটুকু হেঁটে মগবাজার মোড় হয়ে রিকশা নিতাম। বেশিরভাগ সময় ফার্মগেট থেকে বাসে চড়ে সোজা চলে আসতাম গুলিস্তান। তখন ফার্মগেট ছিল একেবারে ফাঁকা। গোটাকয়েক দোকানপাট, সীমিত মানুষজনের আনাগোনা। মমতাজ কনফেকশনারি নামে একটিমাত্র রুটি-বিস্কুটের দোকান। আট আনা ছিল পুরো এক পাউন্ড রুটি। পাশে অবাঙালির এক দোকানে বানাত সুগন্ধি জিলাপি, শিঙাড়া। কখনো সদরঘাট থেকে হেঁটে বা আট আনায় টমটমে চড়ে আসা যেত গুলিস্তান। চাকরির বাইরে অফুরন্ত অবসর সময়ে সারা ঢাকা নির্বিঘ্নে চষে বেড়াতাম। পাবলিক লাইব্রেরি লাগোয়া শরীফ ক্যান্টিনের সুগন্ধি চা ছিল আমাদের বিকেলের অন্যতম আকর্ষণ। প্রায়ই গুলিস্তানের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বন্ধুবান্ধব গল্প করতাম। গুলিস্তান সিনেমা হলের চত্বর ছিল বড্ড পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেখানে ফুটপাতঘেরা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অদূরের বিশাল কামানের দিকে চেয়ে থাকতাম বিস্ময়ে। গুলিস্তান হলের বারান্দা থেকে হালকা আলো ছিটকে পড়ত রাস্তায়। জনবিরল নবাবপুর রোডের ফাঁকা পথ বেয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে মন জুড়িয়ে দিত। রাতের শোতে উত্তম-সুচিত্রার কত হিট ছায়াছবিই না দেখেছি গুলিস্তান সিনেমা হলে। ওপরে অবস্থিত নাজে তখন শুধু ইংরেজি ফিল্ম চলত। সেখানে ছিল ‘চু চিন চো’ নামের একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁ। নিচতলায় গুলিস্তান লাগোয়া ‘গুলসিতান’ রেস্তোরাঁয় তখন সিনেমা অভিনেতাদের আড্ডা জমত। গুলিস্তানের কাছে শালিমারবাদ নামে এক খাবারের দোকানে সবসময় প্রচণ্ড ভিড় লেগে থাকত। মাত্র চার আনা দিয়ে গরুর মাংস ও ভাত পেট পুরে খাওয়া যেত। রসনা তৃপ্ত করে মগবাজার হয়ে হেঁটে হেঁটে গভীর রাতে নির্ভয়ে তেজগাঁওয়ের বাসায় ফিরতাম।

ষাট-সত্তরের দশকে উত্তাল ঢাকার বুকে আজও যেন রয়ে গেছে জনতার সব আন্দোলন-সংগ্রামের চিহ্ন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর নীরব সাক্ষী সেদিনের সেই ছোট্ট ঢাকা শহর। ঢাকার গৌরবদীপ্ত রাজপথগুলোর রক্তের লাল দাগ যেন আপন মহিমায় আজও উজ্জ্বল। ষাটের শেষভাগে ঢাকা এসে তেজগাঁও এলাকায় একটি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি। হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। তখন থেকে আমার লেখালেখির ভিন্ন মাত্রা পায়। সংবাদ তখন ছিল লেখক তৈরির কারখানা। সেখানে ছিল আমার নিয়মিত আসা-যাওয়া, বলতে হয় দ্বিতীয় বাসগৃহ। রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত এবং সর্বশেষ বজলুর রহমান ছিলেন আমার লেখার প্রেরণার উৎস। এ ছাড়া দৈনিক বাংলা, আজাদ, সাপ্তাহিক পূর্বদেশ ও চিত্রাকাশে নিয়মিত গল্প লিখেছি। হাতেগোনা এ কয়টি দৈনিক পত্রিকা আর কিছু সাময়িকী বেরোত ঢাকা থেকে। অনেক পত্রপত্রিকা লেখকের সম্মানী দিত না। একটি গল্পের জন্য দৈনিক বাংলা থেকে বিশ টাকা মিলত। ঐতিহ্যবাহী সে সংবাদ অফিসেই একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদাররা কথাসাহিত্যিক শহীদ সাবেরকে পুড়িয়ে মারল!

এককালের সুন্দর, মনোরম এ শহরটি কত ইতিহাসকে নীরবে বুকে ধারণ করে আছে। ৪০০ বছরের অধিক সময়ের এ পুরোনো শহর বাংলাদেশের রাজধানী হয়েছে আজ পাঁচ দশকের অধিক। এ ক’বছরে কেমন বদলে গেছে শহরটা! স্বচ্ছন্দে ডুবসাঁতার খেলার মতো টলটলে নীল জলেভরা প্রিয় বুড়িগঙ্গার জলে আজ কালো রঙের শুধু বিষ। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল ঢাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রায় ত্রিশটি খালের টলমল স্রোতধারা। লাখো মানুষের জটলা পটলায় এগোনো যায় না সদরঘাটের রাস্তায়। যান্ত্রিকতার দুঃসহ ডামাডোলে বিবর্ণ সেদিনের সবুজ শ্যামল ঢাকা মহানগরী। প্রতিদিনের যানজট, জলাবদ্ধতা, ভয়াবহ বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণে জনজীবন দুর্বিষহ। ইট-পাথরের তৈরি উত্তপ্ত সুউচ্চ ভবনের চাপে বাতাস চলাচলের ন্যূনতম স্থান নেই। নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনের পড়েছে অভাব। ডাস্টবিনের উপচেপড়া ময়লার গন্ধ এড়াতে নাকে রুমাল দেয় রাজধানীবাসী। সেদিনের সেই স্নিগ্ধ রেসকোর্স, রমনা বাগান কেমন ফ্যাকাসে, শ্রীহীন। পত্রপল্লবে, ফুলে ফলে আজ জ্বালানি দহনের কালচে দাগ। সেখানে মানুষের পদচারণায় নেই উচ্ছ্বাস। রেলস্টেশন, টার্মিনালে ছিন্নমূল মানুষের ভিড়। সর্বত্র খুন, রাহাজানি। গুলিস্তান ভবন ভেঙে ফেলে বানানো হলো ইট-বালু-সিমেন্টের এক বিশাল সিন্দুক। সারা রাজধানী চাপা পড়ে গেছে ইট-পাথরে গাঁথা বিশাল বিশাল ভবন নামের আবদ্ধ খাঁচায়। এখানে শিশুরা জানালা গলিয়ে এতটুকু আকাশ দেখার সুযোগ পায় না। উপভোগ করতে পারে না জোৎস্নাভরা রাতের কী রূপ! ওদের জন্য খোলা মাঠ নেই। রাজধানী ঢাকা আজ পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম, খবরটি যেমন দুঃখের তেমন লজ্জার। বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা শহরের রাজনৈতিক, সামাজিক স্থিতিশীলতা, অপরাধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় হলো অধিক জনসংখ্যার চাপ। সর্বশেষ তথ্যমতে জানা যায়, বৃহত্তর ঢাকা ও আশপাশের এলাকার জনসংখ্যা ১৮ মিলিয়ন, আজ তা নিশ্চয়ই আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যা ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩ হাজার ২৩৪ জন মানুষ বাস করে। গত বিশ বছরে মানুষ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ‘বিবিএস’ ও ‘ইউএনএফবিএ’ বলছে, ঢাকা মেগাসিটি দেশের সবচেয়ে বড় পুঞ্জীভূত নগর এলাকা। একটি আদর্শ রাজধানী শহর গড়ে তুলতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও জনগণের সহযোগিতা জরুরি। দূষণমুক্ত, অপরাধমুক্ত, সবার বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলার জন্য জনগণই মূল শক্তি।

একটা স্বাধীন দেশের রাজধানী শহরকে তেপ্পান্ন বছরেও আমরা গড়তে পারলাম না মনের মতো করে। সাজানো বাগানে ভরা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী সুন্দর, মনোরম ঢাকাকে আর কখনো দেখতে পাব কি না, জানি না। তাইতো আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক নিসর্গপ্রেমী উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তার স্বপ্নের শহর ঢাকা যেন ঢাকা পড়েই রইল। বন্ধ করে দেওয়া হলো এর সম্ভাবনাময় মুক্ত দুয়ার। অথচ শ্যামল এক রাজধানী শহর গড়ে তুলতে একসময় তিনি কত শ্রম দিয়েছেন। নটর ডেম কলেজ, রমনা বাগানে কত গাছ লাগিয়েছেন পরম যত্নে। ঢাকা শহরকে ফুলে ফলে সবুজে ভরে দিতে তার পরামর্শই কার্যকর হলো না। বরং তার সযত্নে লাগানো অনেক বিরল প্রজাতির গাছ, উদ্ভিদ অযত্ন-অবহেলায় ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে গেল। পড়ে রইল বৃক্ষ, পত্র-পল্লবহীন ইট-পাথরের এক বস্তির শহর। তার মাঝে কান পেতে যেন আজও শোনা যায় দ্বিজেন শর্মা স্যারের পছন্দের গান ‘তুমি চলে গেছ বকুল বিছানো পথে...’

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সরকারের দ্বৈত ভূমিকায় দেশবাসী উদ্বিগ্ন : সাইফুল হক

লেভারকুজেন ছাড়ার ঘোষণা আলোনসোর, ফিরবেন কি রিয়ালের ডাগআউটে?

আ.লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে যোগ দিল যেসব দল ও সংগঠন

জামায়াতের সমাবেশে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি, আহত ১০

আইপিএলের পর এবার পিএসএলও স্থগিত ঘোষণা

সন্ধ্যা হতেই পাকিস্তানের গোলাবর্ষণ শুরু

ব্রাজিলের কোচ হওয়ার গুঞ্জনে কী বললেন স্কালোনি

জনতার কাতারে নেমে এসেছেন আলেমরাও

ধামরাইয়ে প্রাইভেটকারে যাত্রী তুলে অপহরণ, আটক ৪

শাহবাগে নেই ছাত্রদল-বাম

১০

পাকিস্তান যেসব সমরাস্ত্র ব্যবহার করেছে ভারতের বিরুদ্ধে

১১

সান্তোসে আর মাত্র দু’টি ম্যাচ খেলবেন নেইমার!

১২

শাহবাগে খালেদা জিয়ার অপেক্ষায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র

১৩

বিনিয়োগ নিয়ে দেশে অনেক সার্কাস দেখতে পাচ্ছি : আমীর খসরু

১৪

বিপাকে ভারত, পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছে তুরস্ক

১৫

সাধারণ যানবাহনের সঙ্গেই ছিল জুবাইদার গাড়ি

১৬

মামলা তুলতে রাজি না হওয়ায় বিএনপি কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা

১৭

দ্রুত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত না আসলে ঢাকায় মার্চ : নাহিদ

১৮

নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে হেফাজতের যে আহ্বান

১৯

এবার ভারতের স্টেডিয়াম উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি

২০
X